আল বাকারাহ

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার এক জায়গায় গাভীর উল্লেখ থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মজীদের প্রত্যেকটি সূরায় এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে, যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবী ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও মূলত এটি তো মানুষেরই ভাষা। আর মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো খুব বেশী সংকীর্ণ ও সীমিত পরিসর সম্পন্ন। সেখানে এই ধরনের ব্যাপক বিষয়বস্তুর জন্য পরিপূর্ণ অর্থব্যাঞ্জক শিরোনাম তৈরি করার মতো শব্দ বা বাক্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

এ সূরার বেশীর ভাগ মদীনায় হিজরতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয় । আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। বিষয়স্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের কারণে এগুলোকে প্রথমোক্ত অংশের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সুদ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত যে আয়াতগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয় সেগুলোও এখানে সংযোজিত করা হয়েছে। যে আয়াতগুলো দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে সেগুলো হিজরতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যের কারণে সেগুলোকেও এ সূরার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

নাযিলের উপলক্ষ

এ সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঐতিহাসিক পটভূমি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।

(১) হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায় । এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবলমাত্র আরবের মুশরিকদেরকে। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরতের পরে ইহুদিরা সামনে এসে গেল। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো। তারা তাওহীদ, রিসালাত, অহী, আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত। নীতিগতভাবে তারাও সেই দ্বীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ১ তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামী বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতে এর কোন ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দ্বীনের সাথে যেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মূল বিষয়বস্তুর সাথেও এগুলোর কোন সামঞ্জস্য ছিল না। আল্লাহর কালাম তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দ্বীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তরহিত হয়ে গিয়েছিল । লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তাদের উলামা, মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ –-সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্মজীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রকার সংস্কার-সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে উঠেছিল। যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন, তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি, দ্বীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, দলাদলি, বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’ নামও ভুলে গিয়েছিল। নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর দ্বীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকূ’ এ দাওয়াত সম্বলিত। এ দু’রুকূ’তে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে, সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন্‌ কোন্‌ জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১. এ সময়ের প্রায় ১৯শ’বছর আগে হযরত মূসার (আ) যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাঈলী ইতিহাসের হিসেব মতে হযরত মূসা (আ) খৃঃ পূঃ ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খৃস্টাব্দে নবুয়াত লাভ করেন।

(২) মদীনায় পৌছার পর ইসলামী দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দ্বীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণ দানের মধ্যেই ইসলামী দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদীনায় এসে জমায়েত হতে থাকলো এবং আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্‌ গড়ে উঠলো, তখন মহান আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান দিতে থাকলেন এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। এর অধিকাংশ শুরুতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং কিছু পাঠানো হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্ষিপ্তভাবে।

(৩) হিজরতের পর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতও একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরের মধ্যেই দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করতো, তারা নিজেদের জায়গায় দ্বীনের প্রচার করতো। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরতের পরে এ বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা মদীনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখন্ড তাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এখন এ ছোট্ট জামায়াতটির কেবল সাফল্যই নয় বরং তার অস্তিত্ব ও জীবনই নির্ভর করছিল পাঁচটি জিনিসের ওপর। এক, পূর্ণ শক্তিতে ও পরিপূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে নিজের মতবাদের প্রচার করে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে নিজের চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের অনুসারী করার চেষ্টা করা। দুই, বিরোধীদের বাতিল ও ভ্রান্ত পথের অনুসারী বিষয়টি তাকে এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় না থাকে। তিন, গৃহহারা ও সারা দেশের মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবার কারণে অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার এবং সার্বক্ষণিক অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় সে ভুগছিল। চতুর্দিক থেকে বিপদ তাকে ঘিরে নিয়েছিল। এ অবস্থায় যেন সে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সহকারে যেন অবস্থার মোকাবিলা করে এবং নিজের সংকল্পের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা সৃষ্টির সুযোগ না দেয়। চার, তার দাওয়াতকে ব্যর্থকাম করার জন্য যে কোন দিক থেকে যে কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসবে, পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না। পাঁচ, তার মধ্যে এমন সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে, যার ফলে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে একটুও ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এ পাঁচটি বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

(৪) ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করীমের (সা.) মক্কায় অবস্থান কালের শেষের দিকেই মুনাফিকীর প্রাথমিক আলামতগুলো সুস্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। তবুও সেখানে কেবল এমন ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো যারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং নিজেদের ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু এ সত্যের খাতিরে নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে, নিজেদের পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং এ সত্য মতবাদটি গ্রহণ করার সাথে সাথেই যে সমস্ত বিপদ-আপদ, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন–নির্যাতন নেমে আসতে থাকতো তা মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর এ ধরনের মুনাফিকদের ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। মুনাফিকদের এটি গোষ্ঠী ছিল ইসলামকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী। তারা নিছক ফিত্‌না সৃষ্টি করার জন্য মুসলমানদের দলে প্রবেশ করতো।

মুনাফিকদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অবস্থা ছিল এই যে, চতুর্দিক থেকে মুসলিম কর্তৃত্ব ও প্রশাসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ-সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করতো এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের হিস্‌সা ঝুলিতে রাখতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপ্‌টা থেকেও সংরক্ষিত থাকতো।

তৃতীয় গোষ্ঠীতে এমন ধরনের মুনাফিকদের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ছিল ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে তারা পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাদের গোত্রের বা বংশের বেশির ভাগ লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তাই তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

মুনাফিকদের চতুর্থ গোষ্ঠীটিতে এমন সব লোকের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার–আচরণ, কুসংস্কার ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করতে, নৈতিক বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খল গলায় পরে নিতে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করতে তাদের মন চাইতো না।

সূরা বাকারাহ নাযিলের সময় সবেমাত্র এসব বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ এখানে তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকলো, ততই বিস্তারিতভাবে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

ٱلَّذِينَ ءَاتَيْنَـٰهُمُ ٱلْكِتَـٰبَ يَتْلُونَهُۥ حَقَّ تِلَاوَتِهِۦٓ أُو۟لَـٰٓئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِۦ ۗ وَمَن يَكْفُرْ بِهِۦ فَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْخَـٰسِرُونَ
১২১) যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা১২২ তাকে যথাযথভাবে পাঠ করে। তারা তার ওপর সাচ্চা দিলে ঈমান আনে। আর যারা তার সাথে কুফরীর নীতি অবলম্বন করে তারাই আসলে ক্ষতিগ্রস্ত।
১২২) এখানে আহ্‌লি কিতাবদের অন্তর্গত সৎলোকদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তারা সততা ও দায়িত্বশীলতার সাথে আল্লাহর কিতাব পড়ে। তাই আল্লাহর কিতাবের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকেই তারা সত্য বলে মেনে নেয়।
)
يَـٰبَنِىٓ إِسْرَٰٓءِيلَ ٱذْكُرُوا۟ نِعْمَتِىَ ٱلَّتِىٓ أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّى فَضَّلْتُكُمْ عَلَى ٱلْعَـٰلَمِينَ
১২২) হে বনী১২৩ ইসরাঈল! তোমাদের আমি যে নিয়ামত দান করেছিলাম এবং বিশ্বের জাতিদের ওপর তোমাদের যে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম তার কথা স্মরণ করো।
১২৩) এখান থেকে আর একটি ধারাবাহিক ভাষণ শুরু হচ্ছে। এখানে পরিবেশিত বক্তব্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন।

একঃ হজরত নূহের পরে হযরত ইবরাহীম প্রথম বিশ্বজনীন নবী। মহান আল্লাহ‌ তাঁকে ইসলামের বিশ্বজনীন দাওয়াত ছড়াবার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমে তিনি নিজে সশরীরে ইরাক থেকে মিসর পর্যন্ত এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তীন থেকে নিয়ে আরবের মরু অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান পর্যন্ত বছরের পর বছর সফর করে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের (অর্থাৎ ইসলাম) দিকে আহবান করতে থাকেন। অতঃপর এই মিশন সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। পূর্ব জর্দানে নিজের ভাতিজা হযরত লূতকে নিযুক্ত করেন। সিরিয়া ও ফিলিস্তীনে নিযুক্ত করেন নিজের ছেলে হযরত ইসহাককে এবং আরবের অভ্যন্তরে নিযুক্ত করেন নিজের বড় ছেলে হযরত ইসমাঈলকে। তারপর মহান আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় কা’বাগৃহ নির্মাণ করেন এবং আল্লাহর নির্দেশ মতো এটিকেই এই মিশনের কেন্দ্র গণ্য করেন।

দুইঃ হযরত ইবরাহীমের বংশধারা দু’টি বড় বড় শাখায় বিভক্ত হয়। একটি শাখা হচ্ছে, হযরত ইসমাঈলের সন্তান-সন্ততিবর্গ। এরা আরবে বসবাস করতো। কুরাইশ ও আরবের আরো কতিপয় গোত্র এরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর যেসব আরব গোত্র বংশগত দিক দিয়ে হযরত ইসমাঈলের সন্তান ছিল না তারাও তাঁর প্রচারিত ধর্মে কমবেশী প্রভাবিত ছিল বলেই তাঁর সাথেই নিজেদের সম্পর্ক জুড়তো। দ্বিতীয় শাখাটি ছিল হযরত ইসহাকের সন্তানবর্গের। এই শাখায় হযরত ইয়াকুব, হযরত ইউসূফ, হযরত মূসা, হযরত দাউদ, হযরত সুলাইমান, হযরত ইয়াহ্‌হিয়া, হযরত ঈসা প্রমুখ অসংখ্য নবী জন্মগ্রহণ করেন। আর ইতিপূর্বে বলেছি, যেহেতু হযরত ইয়াকুবের আর এক নাম ছিল ইসরাঈল, তাই তাঁর বংশ বনী ইসরাঈল নামে পরিচিত হয়। তাঁর প্রচার অভিযানের ফলে যেসব জাতি তাঁর দ্বীন গ্রহণ করে তারা তার মধ্যে নিজেদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র বিলুপ্ত করে দেয় অথবা তারা বংশগতভাবে তাদের থেকে আলাদা থাকলেও ধর্মীয়ভাবে তাদের অনুসারী থাকে। এই শাখায় অবনতি ও অধঃপতন সূচিত হলে প্রথমে ইহুদিবাদ ও পরে খৃস্টবাদের উদ্ভব হয়।

তিনঃ হযরত ইবরাহীমের আসল কাজ ছিল সমগ্র দুনিয়াবাসীকে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে আহবান জানানো এবং আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থা পরিশুদ্ধ ও সংশোধিত করে গড়ে তোলা। তিনি নিজে ছিলেন আল্লাহর অনুগত। আল্লাহ‌ প্রদত্ত জ্ঞান অনুযায়ী নিজের জীবনের সমস্ত কাজ-কারবার পরিচালনা করতেন, সারা দুনিয়ায় এই জ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটাতেন এবং চেষ্টা করতেন যাতে সমস্ত মানুষ বিশ্ব-জাহানের মালিক ও প্রভুর অনুগত হয়ে এ দুনিয়ায় জীবন যাপন করে। এই মহান ও বিরাট কর্মকান্ডের প্রেক্ষিতে তাঁকে বিশ্ব নেতার পদে অভিষিক্ত করা হয়। তারপর তাঁর বংশধারা থেকে যে শাখাটি বের হয়ে হযরত ইসহাক ও হযরত ইয়াকুবের নামে অগ্রসর হয়ে বনী ইসরাঈল নাম ধারণ করে সেই শাখাটি তার এ নেতৃত্বের উত্তরাধিকার লাভ করে। এই শাখায় নবীদের জন্ম হতে থাকে এবং এদেরকেই সত্য-সঠিক পথের জ্ঞান দান করা হয়। বিশ্বের জাতিসমূহকে সত্য-সঠিক পথের সন্ধান দেয়ার দায়িত্ব এদের ওপর সোপর্দ করা হয়। এটি ছিল আল্লাহর মহান অনুগ্রহ ও নিয়ামত। মহান আল্লাহ‌ এ বংশের লোকদেরকে তাই একথা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। এ শাখাটি হযরত সুলাইমানের আমলে বাইতুল মাকদিসকে নিজেদের কেন্দ্র গণ্য করে। তাই যতদিন পর্যন্ত এ শাখাটি নেতৃত্বের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল ততদিন পর্যন্ত বাইতুল মাকদিসই ছিল দাওয়াত ইলাল্লাহ---মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানাবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।

চারঃ পেছনের দশটি রুকু’তে মহান আল্লাহ‌ বনী ইসরাঈলকে সম্বোধন করে তাদের ঐতিহাসিক অপরাধসমূহ এবং কুরআন নাযিল হবার সময়ে তাদের যে অবস্থা ছিল তা হুবহু বর্ণনা করেছেন। এ সঙ্গে তাদেরকে একথা জানিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা আমার নিয়ামতের চরম অমর্যাদা করেছো। তোমরা কেবল নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করা থেকে বিরত থাকো নি বরং নিজেরাও সত্য ও সততার পথ পরিহার করেছো। আর এখন তোমাদের একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী ছাড়া তোমাদের সমগ্র দলের মধ্যে আর কোন যোগ্যতা অবশিষ্ট নেই।

পাঁচঃ অতঃপর এখন তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে, বিশ্বমানবতার নেতৃত্ব ইবরাহীমের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার নয়। বরং নবী ইবরাহীম নিজে যে নিষ্কলুষ আনুগত্যের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছিলেন এটি হচ্ছে তারই ফসল। যারা ইবরাহীমের পথে নিজেরা চলে এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে চালাবার দায়িত্ব পালন করে একমাত্র তারাই এই নেতৃত্বের যোগ্যতা লাভ করতে পারে। যেহেতু তোমরা এ পথ থেকে সরে গেছো এবং এ দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছো তাই নেতৃত্বের পদ থেকে তোমাদের অপসারিত করা হচ্ছে।

ছয়ঃ সঙ্গে সঙ্গে ইশারা-ইঙ্গিতে একথাও বলে দেয়া হচ্ছে, যেসব অইসরাঈলী জাতি মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালামের মাধ্যমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে নিজেদের সম্পর্ক জুড়েছিল তারাও ইবরাহীমের পথ থেকে সরে গেছে। এই সঙ্গে একথাও বলে দেয়া হয়েছে যে, আরবের মুশরিকরাও ইবরাহীম ও ইসমাঈলের সাথে নিজেদের সম্পর্ক রয়েছে বলে গর্ব করে বেড়ায় কিন্তু তারা আসলে নিজেদের বংশ ও গোত্রের অহংকারে মত্ত হয়ে পড়েছে। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের পথের সাথে এখন তাদের দূরবর্তী সম্পর্কও নেই। কাজেই তাদের কেউই বিশ্ব নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে না।

সাতঃ আবার একথাও বলা হচ্ছে, এখন আমরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশের দ্বিতীয় শাখা বনী ইসরাঈলের মধ্যে এমন এক নবীর জন্ম দিয়েছি যার জন্য ইবরাহীম ও ইসমাঈল উভয়েই দোয়া করেছিলেন। ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও অন্যান্য সকল নবী যে পথ অবলম্বন করেছিলেন তিনিও সেই একই পথ অবলম্বন করেছেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়ায় যত নবী ও রসূল এসেছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীরা তাদের সবাইকে সত্য নবী বলে স্বীকার করেন। সকল নবী বিশ্ববাসীকে যে পথের দিকে আহবান জানিয়েছেন তিনি ও তাঁর অনুসারীগণও মানুষকে সেদিকে আহবান জানান। কাজেই যারা এ নবীর অনুসরণ করে এখন একমাত্র তারাই বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের যোগ্যতা ও অধিকার রাখে।

আটঃ নেতৃত্ব পরিবর্তনের ঘোষণার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবেই কিব্‌লাহ পরিবর্তনের ঘোষণা হওয়াও জরুরি ছিল। যতদিন বনী ইসরাঈলদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠত ছিল ততদিন বাইতুল মাকদিস ছিল ইসলামী দাওয়াতের কেন্দ্র এবং সেটিই ছিল সত্যপন্থীদের কিব্‌লাহ। শেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ ও তাঁর অনুসারীগণও ততদিন বাইতুল মাকদিসকেই তাঁদের কিব্‌লাহ বানিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বনী ইসরাঈলকে এ পদ থেকে যথারীতি অপসারিত করার পর বাইতুল মাকদিসের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব আপনা-আপনি খতম হয়ে গেল। কাজেই ঘোষণা করে দেয়া হলো, যেখান থেকে এ শেষ নবীর দাওয়াতের সূচনা হয়েছে সেই স্থানটিই হবে এখন আল্লাহর দ্বীনের কেন্দ্র। আর যেহেতু শুরুতে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের কেন্দ্রও এখানে ছিল তাই আহ্‌লি কিতাব ও মুশরিকদের জন্যও এ স্থানটির অর্থাৎ কা’বার কেন্দ্র হবার সর্বাধিক অধিকারের দাবী স্বীকার করে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। অবশ্যি হঠধর্মীদের কথা আলাদা। তারা সত্যকে সত্য জেনেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগ আনতে থাকে।

নয়ঃ উম্মাতে মুহাম্মাদীয়ার নেতৃত্ব ও কা’বার কেন্দ্র হবার কথা ঘোষণা করার পরই মহান আল্লাহ‌ ১৯ রুকূ’ থেকে সূরা বাকারার শেষ পর্যন্ত আলোচনায় ধারাবাহিক হেদায়াতের মাধ্যমে এ উম্মাতের জীবন গঠন ও জীবন পরিচালনার জন্য বিধান দান করেছেন।

)
وَٱتَّقُوا۟ يَوْمًۭا لَّا تَجْزِى نَفْسٌ عَن نَّفْسٍۢ شَيْـًۭٔا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌۭ وَلَا تَنفَعُهَا شَفَـٰعَةٌۭ وَلَا هُمْ يُنصَرُونَ
১২৩) আর সেই দিনকে ভয় করো, যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না, কারোর থেকে ফিদিয়া (বিনিময়) গ্রহণ করা হবে না, কোন সুপারিশ মানুষের জন্য লাভজনক হবে না এবং অপরাধীরা কোথাও কোন সাহায্য পাবে না।
)
۞ وَإِذِ ٱبْتَلَىٰٓ إِبْرَٰهِـۧمَ رَبُّهُۥ بِكَلِمَـٰتٍۢ فَأَتَمَّهُنَّ ۖ قَالَ إِنِّى جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًۭا ۖ قَالَ وَمِن ذُرِّيَّتِى ۖ قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِى ٱلظَّـٰلِمِينَ
১২৪) স্মরণ করো যখন ইবরাহীমকে তার রব কয়েকটি ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন১২৪ এবং সেসব পরীক্ষায় সে পুরোপুরি উত্‌রে গেলো, তখন তিনি বললেনঃ “আমি তোমাকে সকল মানুষের নেতার পদে অধিষ্ঠিত করবো।” ইবরাহীম বললোঃ “আর আমার সন্তানদের সাথেও কি এই অঙ্গীকার?” জবাব দিলেনঃ “আমার এ অঙ্গীকার যালেমদের ব্যাপারে নয়।”১২৫
১২৪) যেসব কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁকে বিশ্বমানবতার নেতৃত্বের পদে অধিষ্ঠিত করার যোগ্য প্রমাণ করেছিলেন কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে সেগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সত্যের আলো তাঁর সামনে সুস্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হবার পর থেকে নিয়ে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সমগ্র জীবন ছিল কুরবানী ও ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। দুনিয়ার যেসব বস্তুকে মানুষ ভালোবাসতে পারে এমন প্রতিটি বস্তুকে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সত্যের জন্য কুরবানী করেছিলেন। দুনিয়ার যে সমস্ত বিপদকে মানুষ ভয় করে সত্যের খাতিরে তার প্রত্যেকটিকে তিনি বরণ করে নিয়েছিলেন।
১২৫) অর্থাৎ এই অঙ্গীকারটি তোমার সন্তানদের কেবলমাত্র সেই অংশটির সাথে সম্পর্কিত যারা সদাচারী, সত্যনিষ্ঠ ও সৎকর্মশীল। তাদের মধ্য থেকে যারা যালেম তাদের জন্য এ অঙ্গীকার নয়। এ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায়, পথভ্রষ্ট ইহুদিরা ও মুশরিক বনী ইসরাঈলরা এ অঙ্গীকারের সাথে সম্পর্কিত নয়।
وَإِذْ جَعَلْنَا ٱلْبَيْتَ مَثَابَةًۭ لِّلنَّاسِ وَأَمْنًۭا وَٱتَّخِذُوا۟ مِن مَّقَامِ إِبْرَٰهِـۧمَ مُصَلًّۭى ۖ وَعَهِدْنَآ إِلَىٰٓ إِبْرَٰهِـۧمَ وَإِسْمَـٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيْتِىَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلْعَـٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ
১২৫) আর স্মরণ করো তখনকার কথা যখন আমি এই গৃহকে (কা’বা) লোকদের জন্য কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল গণ্য করেছিরাম এবং ইবরাহীম যেখানে ইবাদাত করার জন্য দাঁড়ায় সে স্থানটিকে স্থায়ীভাবে নামাযের স্থানে পরিণত করার হুকুম দিয়েছিলাম। আর ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে তাকীদ করে বলেছিলাম, আমার এই গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকূ’-সিজদাকারীদের জন্য পাক-পবিত্র রাখো।১২৬
১২৬) পাক-পবিত্র রাখার অর্থ কেবলমাত্র ময়লা-আবর্জনা থেকে পাক-পবিত্র রাখা নয়। আল্লাহর ঘরের আসল পবিত্রতা হচ্ছে এই যে, সেখানে আল্লাহর ছাড়া আর কারোর নাম উচ্চারিত হবে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ঘরে বসে আল্লাহ‌ ছাড়া আর কাউকে মালিক, প্রভু, মাবুদ, অভাব পূরণকারী ও ফরিয়াদ শ্রবনকারী হিসেবে ডাকে, সে আসলে তাকে নাপাক ও অপবিত্র করে দিয়েছে। এ আয়াতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে কুরাইশ মুশরিকদের অপরাধসমূহের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছেঃ এ যালেমরা ইবরাহীম ও ইসমাঈলের উত্তরাধিকারী হবার জন্য গর্ব করে বেড়ায় কিন্তু উত্তারাধিকারের হক আদায় করার পরিবর্তে এরা উল্টো সেই হককে পদদলিত করে যাচ্ছে। কাজেই ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল তা থেকে বনী ইসরাঈলরা যেমন বাদ পড়েছে তেমনি এই ইসমাইলী মুশরিকরাও বাদ পড়ে গেছে।