আল বাকারাহ

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার এক জায়গায় গাভীর উল্লেখ থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মজীদের প্রত্যেকটি সূরায় এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে, যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবী ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও মূলত এটি তো মানুষেরই ভাষা। আর মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো খুব বেশী সংকীর্ণ ও সীমিত পরিসর সম্পন্ন। সেখানে এই ধরনের ব্যাপক বিষয়বস্তুর জন্য পরিপূর্ণ অর্থব্যাঞ্জক শিরোনাম তৈরি করার মতো শব্দ বা বাক্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

এ সূরার বেশীর ভাগ মদীনায় হিজরতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয় । আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। বিষয়স্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের কারণে এগুলোকে প্রথমোক্ত অংশের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সুদ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত যে আয়াতগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয় সেগুলোও এখানে সংযোজিত করা হয়েছে। যে আয়াতগুলো দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে সেগুলো হিজরতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যের কারণে সেগুলোকেও এ সূরার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

নাযিলের উপলক্ষ

এ সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঐতিহাসিক পটভূমি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।

(১) হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায় । এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবলমাত্র আরবের মুশরিকদেরকে। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরতের পরে ইহুদিরা সামনে এসে গেল। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো। তারা তাওহীদ, রিসালাত, অহী, আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত। নীতিগতভাবে তারাও সেই দ্বীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ১ তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামী বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতে এর কোন ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দ্বীনের সাথে যেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মূল বিষয়বস্তুর সাথেও এগুলোর কোন সামঞ্জস্য ছিল না। আল্লাহর কালাম তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দ্বীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তরহিত হয়ে গিয়েছিল । লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তাদের উলামা, মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ –-সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্মজীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রকার সংস্কার-সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে উঠেছিল। যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন, তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি, দ্বীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, দলাদলি, বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’ নামও ভুলে গিয়েছিল। নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর দ্বীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকূ’ এ দাওয়াত সম্বলিত। এ দু’রুকূ’তে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে, সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন্‌ কোন্‌ জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১. এ সময়ের প্রায় ১৯শ’বছর আগে হযরত মূসার (আ) যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাঈলী ইতিহাসের হিসেব মতে হযরত মূসা (আ) খৃঃ পূঃ ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খৃস্টাব্দে নবুয়াত লাভ করেন।

(২) মদীনায় পৌছার পর ইসলামী দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দ্বীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণ দানের মধ্যেই ইসলামী দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদীনায় এসে জমায়েত হতে থাকলো এবং আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্‌ গড়ে উঠলো, তখন মহান আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান দিতে থাকলেন এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। এর অধিকাংশ শুরুতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং কিছু পাঠানো হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্ষিপ্তভাবে।

(৩) হিজরতের পর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতও একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরের মধ্যেই দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করতো, তারা নিজেদের জায়গায় দ্বীনের প্রচার করতো। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরতের পরে এ বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা মদীনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখন্ড তাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এখন এ ছোট্ট জামায়াতটির কেবল সাফল্যই নয় বরং তার অস্তিত্ব ও জীবনই নির্ভর করছিল পাঁচটি জিনিসের ওপর। এক, পূর্ণ শক্তিতে ও পরিপূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে নিজের মতবাদের প্রচার করে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে নিজের চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের অনুসারী করার চেষ্টা করা। দুই, বিরোধীদের বাতিল ও ভ্রান্ত পথের অনুসারী বিষয়টি তাকে এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় না থাকে। তিন, গৃহহারা ও সারা দেশের মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবার কারণে অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার এবং সার্বক্ষণিক অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় সে ভুগছিল। চতুর্দিক থেকে বিপদ তাকে ঘিরে নিয়েছিল। এ অবস্থায় যেন সে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সহকারে যেন অবস্থার মোকাবিলা করে এবং নিজের সংকল্পের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা সৃষ্টির সুযোগ না দেয়। চার, তার দাওয়াতকে ব্যর্থকাম করার জন্য যে কোন দিক থেকে যে কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসবে, পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না। পাঁচ, তার মধ্যে এমন সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে, যার ফলে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে একটুও ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এ পাঁচটি বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

(৪) ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করীমের (সা.) মক্কায় অবস্থান কালের শেষের দিকেই মুনাফিকীর প্রাথমিক আলামতগুলো সুস্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। তবুও সেখানে কেবল এমন ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো যারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং নিজেদের ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু এ সত্যের খাতিরে নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে, নিজেদের পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং এ সত্য মতবাদটি গ্রহণ করার সাথে সাথেই যে সমস্ত বিপদ-আপদ, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন–নির্যাতন নেমে আসতে থাকতো তা মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর এ ধরনের মুনাফিকদের ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। মুনাফিকদের এটি গোষ্ঠী ছিল ইসলামকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী। তারা নিছক ফিত্‌না সৃষ্টি করার জন্য মুসলমানদের দলে প্রবেশ করতো।

মুনাফিকদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অবস্থা ছিল এই যে, চতুর্দিক থেকে মুসলিম কর্তৃত্ব ও প্রশাসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ-সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করতো এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের হিস্‌সা ঝুলিতে রাখতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপ্‌টা থেকেও সংরক্ষিত থাকতো।

তৃতীয় গোষ্ঠীতে এমন ধরনের মুনাফিকদের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ছিল ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে তারা পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাদের গোত্রের বা বংশের বেশির ভাগ লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তাই তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

মুনাফিকদের চতুর্থ গোষ্ঠীটিতে এমন সব লোকের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার–আচরণ, কুসংস্কার ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করতে, নৈতিক বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খল গলায় পরে নিতে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করতে তাদের মন চাইতো না।

সূরা বাকারাহ নাযিলের সময় সবেমাত্র এসব বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ এখানে তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকলো, ততই বিস্তারিতভাবে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

قَالَ إِنَّهُۥ يَقُولُ إِنَّهَا بَقَرَةٌۭ لَّا ذَلُولٌۭ تُثِيرُ ٱلْأَرْضَ وَلَا تَسْقِى ٱلْحَرْثَ مُسَلَّمَةٌۭ لَّا شِيَةَ فِيهَا ۚ قَالُوا۟ ٱلْـَٔـٰنَ جِئْتَ بِٱلْحَقِّ ۚ فَذَبَحُوهَا وَمَا كَادُوا۟ يَفْعَلُونَ
৭১) মূসা জবাব দিল আল্লাহ‌ বলছেন, সেটি এমন একটি গাভী যাকে কোন কাজে নিযুক্ত করা হয়না, জমি চাষ বা ক্ষেতে পানি সেচ কোনটিই করে না, সুস্থ-সবল ও নিখুঁত। একথায় তারা বলে উঠলো, হ্যাঁ,, এবার তুমি ঠিক সন্ধান দিয়েছো। অতঃপর তারা তাকে যবেহ করলো, অন্যথায় তারা এমনটি করতো বলে মনে হচ্ছিল না।৮৪
৮৪) তাদের প্রতিবেশী জাতিরা গরুকে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র মনে করতো এবং গরু পূজা করতো আর প্রতিবেশীদের থেকে এ রোগ তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়, তাই তাদেরকে গরু যবেহ করার হুকুম দেয়া হয়। তাদের ঈমানের পরীক্ষা এভাবেই হওয়া সম্ভবপর ছিল। এখন যদি তারা যথার্থই আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে মাবুদ বলে স্বীকার না করে তাহলে এ আকীদা গ্রহণ করার পূর্বে যেসব ঠাকুর-দেবতার মূর্তিকে তারা মাবুদ মনে করে আসছিল তাদেরকে নিজের হাতে ভেঙে ফেলতে হবে। এটা অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। তাদের দিলের মধ্যে ঈমান পুরোপুরি বাসা বাঁধতে পারেনি, তাই তারা টালবাহানা করতে থাকে এবং বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাক। কিন্তু যতই বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে ততই তারা নিজেরা ঘেরাও হয়ে যেতে থাকে। অবশেষে সেকালে যে বিশেষ ধরনের সোনালী গাভীর পূজা করা হতো তার প্রতি প্রায় অংগুলি নির্দেশ করে তাকেই যবেহ করতে বলা হলো। বাইবেলেও এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তবে বনী ইসরাঈলরা এ নির্দেশটি উপেক্ষা করার জন্য কোন্ ধরনের টালবাহানা করেছিল, তা সেখানে বলা হয়নি। (গণনা পুস্তক, ১৯ অধ্যায়, ১-১০ শ্লোক)।
وَإِذْ قَتَلْتُمْ نَفْسًۭا فَٱدَّٰرَْٰٔتُمْ فِيهَا ۖ وَٱللَّهُ مُخْرِجٌۭ مَّا كُنتُمْ تَكْتُمُونَ
৭২) আর স্মরণ করো সেই ঘটনার কথা যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে এবং একজন আর একজনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিয়োগ আনছিলে। আর আল্লাহ‌ সিদ্ধান্ত করেছিলেন তোমরা যা কিছু গোপন করছো তা তিনি প্রকাশ করে দেবেন।
)
فَقُلْنَا ٱضْرِبُوهُ بِبَعْضِهَا ۚ كَذَٰلِكَ يُحْىِ ٱللَّهُ ٱلْمَوْتَىٰ وَيُرِيكُمْ ءَايَـٰتِهِۦ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
৭৩) সে সময় আমরা হুকুম দিলাম, নিহতের লাশকে তার একটি অংশ দিয়ে আঘাত করো। দেখো এভাবে আল্লাহ‌ মৃতদের জীবন দান করেন এবং তোমাদেরকে নিজের নিশানী দেখান, যাতে তোমরা অনুধাবন করতে পারো।৮৫
৮৫) এখানে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে, হত্যাকারীর সন্ধান বলে দেয়ার জন্য নিহত ব্যক্তির লাশের মধ্যে পুনরায় কিছুক্ষণের জন্য প্রাণস্পন্দন ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এজন্য যে কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির লাশকে তার একটি অংশ দিয়ে আঘাত করার যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। তবুও এর ব্যাখ্যায় প্রাচীনতম তাফসীরকারগণ যা বলেছেন তাকেই এর নিকটতম অর্থ ধরা যায়। অর্থাৎ আগে যে গাভী যবেহ করা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তারই গোশ্ত দিয়ে নিহত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত করতে বলা হয়েছিল। এভাবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা গেলো। প্রথমত আল্লাহর কুদরাত ও অসীম ক্ষমতার একটি প্রমাণ তাদের সামনে তুলে ধরা হলো। দ্বিতীয়ত গরুর পবিত্রতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও তাকে উপাস্য হবার যোগ্যতার ওপরও একটি শক্তিশালী আঘাত হানা হলো। এই তথাকথিত উপাস্যটি যদি সামান্যতম ক্ষমতারও অধিকারী হতো তাহলে তাকে যবেহ করার কারণে একটি মহাবিপদ ও দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতো। কিন্তু বিপরীত পক্ষে আমরা দেখছি তা মানুষের কল্যাণে লেগেছে।
ثُمَّ قَسَتْ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعْدِ ذَٰلِكَ فَهِىَ كَٱلْحِجَارَةِ أَوْ أَشَدُّ قَسْوَةًۭ ۚ وَإِنَّ مِنَ ٱلْحِجَارَةِ لَمَا يَتَفَجَّرُ مِنْهُ ٱلْأَنْهَـٰرُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَشَّقَّقُ فَيَخْرُجُ مِنْهُ ٱلْمَآءُ ۚ وَإِنَّ مِنْهَا لَمَا يَهْبِطُ مِنْ خَشْيَةِ ٱللَّهِ ۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَـٰفِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
৭৪) কিন্তু এ ধরনের নিশানী দেখার পরও তোমাদের দিল কঠিন হয়ে গেছে, পাথরের মত কঠিন বরং তার চেয়েও কঠিন। কারণ এমন অনেক পাথর আছে যার মধ্য দিয়ে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয় আবার অনেক পাথর ফেটে গেলে তার মধ্য থেকে পানি বের হয়ে আসে, আবার কোন কোন পাথর আল্লাহর ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পড়েও যায়। আল্লাহ‌ তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে বেখবর নন।
)
۞ أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا۟ لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌۭ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَـٰمَ ٱللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُۥ مِنۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ
৭৫) হে মুসলমানরা! তোমরা কি তাদের থেকে আশা করো তারা তোমাদের দাওয়াতের ওপর ঈমান আনবে?৮৬ অথচ তাদের একটি দলের চিরাচরিত রীতি এই চলে আসছে যে, আল্লাহর কালাম শুনার পর খুব ভালো করে জেনে বুঝে সজ্ঞানে তার মধ্যে ‘তাহরীফ’ বা বিকৃতি সাধন করেছে।৮৭
৮৬) এখানে মদীনার নওমুসলিমদেরকে সম্বোধন করা হয়েছে। তারা নিকটবর্তী কালে শেষ নবীর ওপর ঈমান এনেছিল। ইতিপূর্বে নবুওয়াত, শরীয়াত, কিতাব, ফেরেশতা, আখেরাত ইত্যাদি শব্দগুলো তাদের কানে পৌঁছে ছিল। এসব তারা শুনেছিল তাদের প্রতিবেশী ইহুদিদের কাছ থেকে। তারা ইহুদিদের মুখ থেকে আরো শুনেছিল যে, দুনিয়ায় আরো একজন নবী আসবেন। যারা তাঁর সাথে সহযোগিতা করবে সারা দুনিয়ায় তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এই জানার ভিত্তিতে মদীনাবাসীরা নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াতের চর্চা শুনে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। এখন তারা আশা করছিল, যারা আগে থেকে নবী ও আসমানী কিতাবের অনুসারী এবং যাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত খবরের বদৌলতে তারা ঈমানের মহামূল্যবান সম্পদের অধিকারী হয়েছে, তারা নিশ্চয়ই তাদের সহযোগী হবে। বরং এ পথে তারা অগ্রগামী হবে। এই বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে মদীনার উদ্যোগী নওমুসলিমরা তাদের ইহুদি বন্ধু ও প্রতিবেশীদের কাছে যেতো এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতো। তারা এ দাওয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে মুনাফিক ও ইসলাম বিরোধীরা এ সুযোগ গ্রহণ করতো। তারা এ থেকে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করতো যে, ব্যাপারটা বেশ সন্দেহজনক ও সংশয়পূর্ণ মনে হচ্ছে, নইলে মুহাম্মাদ ﷺ যদি সত্যিই নবী হতেন তাহলে ‘আহলি কিতাব’দের উলামা, মাশায়েখ ও পবিত্র বুযর্গগণ কি জেনে বুজে ঈমান আনতে অস্বীকৃতি জানাতো এবং তারা কি অনর্থক এভাবে নিজেদের পরকাল নষ্ট করতো? তাই বনী ইসরাইলদের অতীত ইতিহাস বর্ণনা করার পর এবার সরল প্রাণ মুসলমানদেরকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে, অতীতে যারা এ ধরনের কীর্তিকলাপ করেছে তাদের ব্যাপারে তোমরা বেশী কিছু আশা করো না। অন্যথায় তোমাদের দাওয়াত তাদের পাষাণ অন্তরে ধাক্কা খেয়ে যখন ফিরে আসবে তখন তোমাদের মন ভেঙে পড়বে। এই ইহুদিরা শত শত বছর থেকে বিকৃত হয়ে আছে। আল্লাহর যে সমস্ত আয়াত শুনে তোমাদের দিল কেঁপে ওঠে সেগুলোকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে করতে তাদের কয়েক পুরুষ কেটে গেছে। আল্লাহর সত্য দ্বীনকে তারা নিজেদের ইচ্ছা ও চাহিদা মোতাবিক বিকৃত করেছে। এই বিকৃত দ্বীনের মাধ্যমেই তারা পরকালীন নাজাত লাভের প্রত্যাশী। সত্যের আওয়াজ বুলন্দ হবার সাথে সাথেই তারা সেদিকে দৌঁড়ে যাবে, তাদের সম্পর্কে এ ধারণা রাখা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৮৭) “একটি দল” বলতে তাদের উলামা ও শরীয়াতধারীদেরকে বুঝানো হয়েছে। এখানে তাওরাত, যাবুর ও অন্যান্য কিতাব, যেগুলো তারা নিজেদের নবীদের মাধ্যমে লাভ করেছিল, সেগুলোকেই বলা হয়েছে “আল্লাহর কালাম।” ‘তাহরীফ’ অর্থ হচ্ছে কোন কথাকে তার আসল অর্থ ও তাৎপর্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের ইচ্ছে মতো এমন কোন অর্থে ব্যবহার করা যা বক্তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপন্থী। তাছাড়া শব্দের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করাকেও তাহরীফ বলে। বনী ইসরাঈলী আলেমগণ আল্লাহর কালামের মধ্যে এই দু’ধরনের তাহরীফ বা বিকৃতি সাধন করেছিল।