ইয়া-সীন

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

যে দু’টি হরফ দিয়ে সূরার সূচনা করা হয়েছে তাকেই এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

বর্ণনাভঙ্গী দেখে অনুভব করা যায়, এ সূরার নাযিল হবার সময়টি হবে নবী করীমের ﷺ নবুওয়াত লাভ করার পর মক্কায় অবস্থানের মধ্যবর্তী যুগের শেষের দিনগুলো। অথবা এটি হবে তাঁর মক্কায় অবস্থানের একেবারে শেষ দিনগুলোর একটি সূরা।

বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়

কুরাইশ বংশীয় কাফেরদের মুহাম্মাদ ﷺ এর নবুওয়াতের ওপর ঈমান না আনা এবং জুলুম ও বিদ্রূপের মাধ্যমে তার মোকাবিলা করার পরিণামের ভয় দেখানোই এ আলোচনার লক্ষ্য। এর মধ্যে ভয় দেখানোর দিকটি প্রবল ও সুস্পষ্ট। কিন্তু বার বার ভয় দেখানোর সাথে যুক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে বিষয়বস্তু বুঝাবার ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

তিনটি বিষয়ের ওপর যুক্তি প্রদর্শন করা হয়েছেঃ

  • তাওহীদের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী ও সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে।
  • আখেরাতের ওপর বিশ্ব-জাহানের নিদর্শনাবলী, সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি ও মানুষের নিজের অস্তিত্বের সাহায্যে।
  • মুহাম্মাদী নবুওয়াতের সত্যতার ওপর একথার ভিত্তিতে যে, তিনি নিজের রিসালাতের ক্ষেত্রে এ সমস্ত কষ্ট সহ্য করেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে এবং এ বিষয়ের ভিত্তিতে যে, তিনি লোকদেরকে যেসব কথার প্রতি আহবান জানাচ্ছিলেন সেগুলো পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত ছিল এবং সেগুলো গ্রহণ করার মধ্যেই ছিল লোকদের নিজেদের কল্যাণ।

    এ যুক্তি প্রদর্শনের শক্তির ওপর ভীতি প্রদর্শন এবং তিরস্কার ও সতর্ক করার বিষয়বস্তু অত্যন্ত জোরে শোরে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে হৃদয়ের তালা খুলে যায় এবং যাদের মধ্যে সত্যকে গ্রহণ করার সামান্যতম যোগ্যতাও আছে তারা যেন কুফরীর ওপর বহাল থাকতে না পারে।

    ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ ও তাবারানী প্রমুখগণ মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী ﷺ বলেন, يس قَلْبُ الْقُرْآنِ অর্থাৎ এ ইয়া-সীন সূরাটি কুরআনের হৃদয়। এটি ঠিক তেমনই একটি উপমা যেমন সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন বলা হয়েছে। ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন গণ্য করার কারণ হচ্ছে এই যে, তার মধ্যে কুরআন মজীদের সমস্ত শিক্ষার সংক্ষিপ্তসার এসে গেছে। অন্যদিকে ইয়াসীনকে কুরআনের স্পন্দিত হৃদয় বলা হয়েছে এজন্য যে, কুরআনের দাওয়াতকে সে অত্যন্ত জোরেশোরে পেশ করে, যার ফলে জড়তা কেটে যায় এবং প্রাণপ্রবাহ গতিশীল হয়।

    এই হযরত মা’কাল ইবনে ইয়াসার থেকেই হযরত ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ বর্ণনা করেছেন যে, নবী ﷺ বলেন, اقْرَءُوا سُورَةَ يسعلى موتاكم “তোমাদের মৃতদের ওপর সূরা ইয়াসীন পাঠ করো।” এর পেছনে যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা হচ্ছে এই যে, এর মাধ্যমে মরার সময় মুসলমানের অন্তরে কেবলমাত্র ইসলামী আকীদা বিশ্বাসই তাজা হয়ে যায় না বরং বিশেষভাবে তার সামনে আখেরাতের পূর্ণ চিত্রও এসে যায় এবং সে জানতে পারে দুনিয়ার জীবনের মনযিল অতিক্রম করে এখন সামনের দিকে কোন্‌ সব মনযিল পার হয়ে তাকে যেতে হবে। এ কল্যাণকারিতাকে পূর্ণতা দান করার জন্য আরবী জানে না এমন ব্যক্তিকে সূরা ইয়াসীন শুনাবার সাথে সাথে তার অনুবাদও শুনিয়ে দেয়া উচিত। এভাবে উপদেশ দান ও স্মরণ করিয়ে দেবার হক পুরোপুরি আদায় হয়ে যায়।

بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَـٰنِ ٱلرَّحِيمِ يسٓ
১) ইয়া-সীন।
১) ইবনে আব্বাস, ইকরামা, দ্বাহ্হাক, হাসান বসরী ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার বক্তব্য মতে এর অর্থ হচ্ছে, “হে মানুষ” অথবা “ওহে লোক” এবং কোন কোন মুফাস্‌সির একে “ইয়া সাইয়েদ” এর সংক্ষিপ্ত উচ্চারণও গণ্য করেন। এ ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতে ধরা যায় নবী ﷺ কে উদ্দেশ্য করে এ শব্দগুলো বলা হয়েছে।
وَٱلْقُرْءَانِ ٱلْحَكِيمِ
২) বিজ্ঞানময় কুরআনের কসম,
)
إِنَّكَ لَمِنَ ٱلْمُرْسَلِينَ
৩) তুমি নিঃসন্দেহে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত,
২) এভাবে বক্তব্য শুরু করার কারণ নাউযুবিল্লাহ এ নয় যে, নবী ﷺ তাঁর নবুওয়াতের ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দিহান ছিলেন এবং তাঁকে নিশ্চয়তা দান করার জন্য আল্লাহ‌র একথা বলার প্রয়োজন হয়েছিল। বরং এর কারণ হচ্ছে এই যে, সে সময় কুরাঈশ বংশীয় কাফেররা অত্যন্ত জোরেশোরে নবী করীমের ﷺ নবুওয়াত অস্বীকার করছিল। তাই আল্লাহ‌ কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই তাঁর ভাষণ শুরুই করেছেন এ বাক্য দিয়ে যে, “তুমি নিশ্চয়ই রসূলদের অন্তর্ভুক্ত।” অর্থাৎ যারা তোমার নবুওয়াত অস্বীকার করছে তারা বিরাট ভুল করছে। তারপর একথার ওপর কুরআনের কসম খাওয়া হয়েছে এবং কুরআনের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে “বিজ্ঞানময়” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এই যে, তোমার নবী হবার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এ কুরআন যা পুরোপুরি জ্ঞানে পরিপূর্ণ। এ জিনিসটি নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, যে ব্যক্তি এমন জ্ঞানপূর্ণ বাণী উপস্থাপন করছেন তিনি নিঃসন্দেহে আল্লাহ‌র রসূল। কোন মানুষ এমন ধরনের বাণী রচনা করার ক্ষমতা রাখে না। আর মুহাম্মাদ ﷺ কে যারা জানতো তাদের পক্ষে কোনক্রমেই এ বিভ্রান্তির শিকার হওয়া সম্ভব ছিল না যে, এ বাণী তিনি নিজে রচনা করে আনছেন অথবা অন্য কোন মানুষের কাছ থেকে শিখে এসে শুনাচ্ছেন। (এ বিষয়বস্তু বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা ইউনুস, ২০, ২১, ২২, ৪৪, ৪৫; বনী ইসরাঈল, ১০৪, ১০৫, টীকা; সূরা নূরের ভূমিকা; সূরা আশ্ শূআরা ১; আন নামল, ৯২; আল কাসাস ৬২, ৬৩, ৬৪, ১০২-১০৯; আল আনকাবুত, ৮৮-৯১ টীকা এবং আর রুমের ঐতিহাসিক পটভূমি ও ১, ২, ৩ টীকা।)
عَلَىٰ صِرَٰطٍۢ مُّسْتَقِيمٍۢ
৪) সরল-সোজা পথ অবলম্বনকারী
)
تَنزِيلَ ٱلْعَزِيزِ ٱلرَّحِيمِ
৫) (এবং এ কুরআন) প্রবল পরাক্রমশালী ও করুণাময় সত্তার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত,
৩) এখানে কুরআন নাযিলকারীর দু’টি গুণের কথা বলা হয়েছে। এক, তিনি প্রবল ও পরাক্রান্ত। দুই, তিনি করুণাময়। প্রথম গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ সত্যটি সম্পর্কে সতর্ক করা যে, এ কুরআন কোন অক্ষম উপদেষ্টার উপদেশ নয় যে, একে উপেক্ষা করলে তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। বরং এটি এমন বিশ্ব-জাহানের মালিকের ফরমান যিনি সবার ওপর প্রবল পরাক্রান্ত, যাঁর ফায়সালাসমূহ প্রয়োগ করার পথে কোন শক্তি বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না এবং যাঁর পাকড়াও থেকে রেহাই পাবার ক্ষমতা করো নেই। আর দ্বিতীয় গুণটি বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে এ অনুভূতি সৃষ্টি করা যে, তিনি নিছক দয়াপরবশ হয়ে তোমাদের হিদায়াত ও পথ দেখাবার জন্য নিজের রসূল পাঠিয়েছেন এবং এ মহান কিতাবটি নাযিল করেছেন, যাতে তোমরা গোমরাহী মুক্ত হয়ে এমন সরল সঠিক পথে চলতে পারো যে পথে চলে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্য লাভ করতে পারবে।