আল মায়েদাহ

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

এ সূরার ১৫ রুকূ’র هَلْ يَسْتَطِيعُ رَبُّكَ أَنْ يُنَزِّلَ عَلَيْنَا مَائِدَةً مِنَ السَّمَاءِ আয়াতে উল্লেখিত “মায়েদাহ” শব্দ থেকে এ নামকরণ করা হয়েছে। কুরআনের অধিকাংশ সূরার নামের মতো এ সূরার নামের সাথেও এর আলোচ্য বিষয়বস্তুর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। নিছক অন্যান্য সূরা থেকে আলাদা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্যই একে এ নামে অভিহিত করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

হোদাইবিয়ার সন্ধির পর ৬ হিজরীর শেষের দিকে অথবা ৭ হিজরীর প্রথম দিকে এ সূরাটি নাযিল হয়। সূরায় আলোচ্য বিষয় থেকে একথা সুস্পষ্ট হয় এবং হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনাও এর সত্যতা প্রমাণ করে। ষষ্ঠ হিজরীর যিলকাদ মাসের ঘটনা। চৌদ্দশ’ মুসলমানকে সাথে নিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু কুরাইশ কাফেররা শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আরবের প্রাচীনতম ধর্মীয় ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁকে উমরাহ করতে দিল না। অনেক তর্ক বিতর্ক ও বাদানুবাদের পর তারা এতটুকু মেনে নিল যে, আগামী বছর আপনারা আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার জন্য আসতে পারেন। এ সময় একদিকে মুসলমানদেরকে কাবাঘর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করার নিয়ম কানুন বাতলে দেবার প্রয়োজন ছিল, যাতে পরবর্তী বছর পূর্ণ ইসলামী শান শওকতের সাথে উমরাহর সফর করা যায় এবং অন্য দিকে তাদেরকে এ মর্মে ভালভাবে তাকীদ করারও প্রয়োজন ছিল যে, কাফের শত্রু দল তাদের উমরাহ করতে না দিয়ে যে বাড়াবাড়ি করেছে তার জবাবে তারা নিজেরা অগ্রবর্তী হয়ে যেন আবার কাফেরদের ওপর কোন অন্যায় বাড়াবাড়ি ও জুলুম না করে বসে। কারণ অনেক কাফের গোত্রকে হজ্জ সফরের জন্য মুসলিম অধিকারভুক্ত এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া আসা করতে হতো। মুসলমানদেরকে যেভাবে কাবা যিয়ারত করতে দেয়া হয়নি সেভাবে তারাও এ ক্ষেত্রে জোর পূর্বক এসব কাফের গোত্রের কাবা যিয়ারতের পথ বন্ধ করে দিতে পারতো। এ সূরার শুরুতে ভূমিকাস্বরূপ যে ভাষণটির অবতারণা করা হয়েছে সেখানে এ প্রসংগই আলোচিত হয়েছে। সামনের দিকে তের রুকূ’তে আবার এ প্রসংগটি উত্থাপিত হয়েছে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, প্রথম রুকূ’ থেকে নিয়ে চৌদ্দ রুকূ’ পর্যন্ত একই ভাষণের ধারাবাহিকতা চলছে। এ ছাড়াও এ সূরার মধ্যে আর যে সমস্ত বিষয়বস্তু আমরা পাই তা সবই একই সময়কার বলে মনে হয়।

বর্ণনার ধারাবাহিকতা দেখে মনে হয় এ সমগ্র সূরাটি একটি মাত্র ভাষণের অন্তর্ভুক্ত এবং সম্ভবত এটি একই সঙ্গে নাযিল হয়েছে। আবার এর কোন কোন আয়াত পরবর্তীকালে পৃথক পৃথকভাবে নাযিল হতেও পারে এবং বিষয়বস্তুর একাত্মতার কারণে সেগুলোকে এ সূরার বিভিন্ন স্থানে জায়গা মতো জুড়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্ণনার ধারাবাহিকতার মধ্যে কোথাও সামান্যতম শূন্যতাও অনুভূত হয় না। ফলে একে দু’টি বা তিনটি ভাষণের সমষ্টি মনে করার কোন অবকাশ নেই।

নাযিলের উপলক্ষ্য

আলে ইমরান ও আন্ নিসা সূরা দু’টি যে যুগে নাযিল হয় সে যুগ থেকে এ সূরাটির নাযিলের যুগে পৌঁছতে পৌঁছতে বিরাজমান পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে অনেক বড় রকমের পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। ওহোদ যুদ্ধের বিপর্যয় যেখানে মদীনার নিকটতম পরিবেশও মুসলমানদের জন্য বিপদসংকুল করে তুলেছিল। সেখানে এখন সম্পূর্ণ ভিন্নতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। আরবে ইসলাম এখন একটি অজেয় ও অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র একদিকে নজ্দ থেকে সিরিয়া সীমান্ত এবং অন্যদিকে লোহিত সাগর থেকে মক্কার নিকট এলাকা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। ওহোদে মুসলমানরা যে আঘাত পেয়েছিল তা তাদের হিম্মত ও সাহসকে দমিত এবং মনোবলকে নিস্তেজ করার পরিবর্তে তাদের সংকল্প ও কর্মোন্মদানার জন্য চাবুকের কাজ করেছিল। তারা আহত সিংহের মতো গর্জে ওঠে এবং তিন বছরের মধ্যে সমগ্র পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টা, সংগ্রাম ও আত্মদানের ফলে মদীনার চারদিকে দেড়শ’, দুশ’ মাইলের মধ্যে সমস্ত বিরোধী গোত্রের শক্তির দর্প চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। মদীনার ওপর সবসময় যে ইহুদী বিপদ শকুনির মতো ডানা বিস্তার করে রেখেছিল তার অশুভ পাঁয়তারার অবসান ঘটেছিল চিরকালের জন্য। আর হিজাযের অন্যান্য যেসব জায়গায় ইহুদী জনবসতি ছিল সেসব এলাকা মদীনার ইসলামী শাসনের অধীনে এসে গিয়েছিল। ইসলামের শক্তিকে দমন করার জন্য কুরাইশরা সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছিল খন্দকের যুদ্ধে। এতেও তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর আরববাসীদের মনে এ ব্যাপারে আর কোন সন্দেহই রইলো না যে, ইসলামের এ আন্দোলনকে খতম করার সাধ্য দুনিয়ার আর কোন শক্তির নেই। ইসলাম এখন আর নিছক একটি আকীদা-বিশ্বাস ও আদর্শের পর্যায় সীমিত নয়। নিছক মন ও মস্তিষ্কের ওপরই তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং ইসলাম এখন একটি পরাক্রান্ত রাষ্ট্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের সীমানায় বসবাসকারী সমস্ত অধিবাসীর জীবনের ওপর তার কর্তৃত্ব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত। এখন মুসলমানরা এতটা শক্তির অধিকারী যে, যে চিন্তা ও ভাবধারার ওপর তারা ঈমান এনেছিল সে অনুযায়ী স্বাধীনভাবে নিজেদের জীবনকে গড়ে তোলার এবং সে চিন্তা ও ভাবধারা ছাড়া অন্য কোন আকীদা-বিশ্বাস, ভাবধারা, কর্মনীতি অথবা আইন-বিধানকে নিজেদের জীবন ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করতে না দেয়ার পূর্ণ ইখতিয়ার তারা লাভ করেছিল।

তাছাড়া এ কয়েক বছরের মধ্যে ইসলামী মূলনীতি ও দৃষ্টিভংগী অনুযায়ী মুসলমানদের নিজস্ব একটি কৃষ্টি ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল। এ সংস্কৃতি জীবনের যাবতীয় বিস্তারিত বিষয়ে অন্যদের থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র ভাবমূর্তির অধিকারী ছিল। নৈতিকতা, স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ, জীবন যাপন প্রণালী, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি যাবতীয় ক্ষেত্রে মুসলমানরা এখন অমুসলিমদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইসলামী রাষ্ট্রের সমস্ত মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে মসজিদ ও জামায়াতে সাথে নামায পড়ার ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক জনবসতিতে ও প্রত্যেক গোত্রে একজন ইমাম নিযুক্ত রয়েছে। ইসলামের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন-কানুন অনেকটা বিস্তারিত আকারে প্রণীত হয়ে গেছে এবং মুসলমানদের নিজস্ব আদালতের মাধ্যমে সর্বত্র সেগুলো প্রবর্তিত হচ্ছে। লেনদেন ও কেনা–বেচা ব্যবসায় বাণিজ্যের পুরাতন রীতি ও নিয়ম রহিত করে নতুন সংশোধিত পদ্ধতির প্রচলন চলছে। সম্পত্তি উত্তরাধিকারের স্বতন্ত্র বিধান তৈরী হয়ে গেছে। বিয়ে ও তালাকের আইন, শ’রয়ী পর্দা ও অনুমতি নিয়ে অন্যের গৃহে প্রবেশের বিধান এবং যিনা ও মিথ্যা অপবাদের শাস্তি বিধান জারি হয়ে গেছে। এর ফলে মুসলমানদের সমাজ জীবন একটি বিশেষ ছাঁচে গড়ে উঠতে শুরু করেছে। মুসলমানদের ওঠা বসা, কথাবার্তা, পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং জীবন যাপন ও বসবাস করার পদ্ধতিও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল হয়ে উঠেছে। এভাবে ইসলামী জীবন একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করার এবং মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও তামাদ্দুন গড়ে ওঠার পর, তারা যে আবার কোন দিন অমুসলিম সমাজের সাথে মিলে একাত্ম হয়ে যেতে পারে। তেমনটি আশা করা তৎকালীন অমুসলিম বিশ্বের পক্ষে আর সম্ভবপর ছিল না।

হোদায়বিয়ার চুক্তি সম্পাদিত হবার পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধক ছিল এই যে, কুরাইশ কাফেরদের সাথে তাদের ক্রমাগত যুদ্ধ, সংঘর্ষ ও সংঘাত লেগেই ছিল। নিজেদের ইসলামী দাওয়াতে সীমানা বৃদ্ধি ও এর পরিসর প্রশস্ত করার জন্য অবকাশই তারা পাইনি। হোদাইবিয়ার বাহ্যিক পরাজয় ও প্রকৃত বিজয় এ বাধা দূর করে দিয়েছিল। এর ফলে কেবল নিজেদের রাষ্ট্রীয় সীমায়ই তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে পায়নি বরং আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ইসলামের দাওয়াত বিস্তৃত করার সুযোগ এবং অবকাশও লাভ করেছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কাজটিরই উদ্ধোধন করলেন ইরান, রোম মিসর ও আরবের বাদশাহ ও রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে পত্র লেখার মাধ্যমে। এ সাথে ইসলাম প্রচারকবৃন্দ মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে আহবান জানাবার জন্য বিভিন্ন গোত্র ও কওমের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লেন।

আলোচ্য বিষয়সমূহ

এ ছিল সূরা মা-য়েদাহ নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট। নিম্নলিখিত তিনটি বড় বড় বিষয় এ সূরাটির অন্তর্ভুক্তঃ

একঃ মুসলমানদের ধর্মীয়, তামাদ্দুনিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আরো কিছু বিধি নির্দেশ। এ প্রসংগে হজ্জ সফরের রীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। ইসলামী নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং কাবা যিয়ারতকারীদেরকে কোন প্রকার বাধা না দেবার হুকুম দেয়া হয়। পানাহার দ্রব্য সামগ্রীর মধ্যে হালাল ও হারামের চূড়ান্ত সীমা প্রবর্তিত হয়। জাহেলী যুগের মনগড়া বাধা নিষেধগুলো উঠিয়ে দেয়া হয়। আহলী কিতাবদের সাথে পানাহার ও তাদের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি দেয়া হয়। অযু, গোসল ও তায়াম্মুম করার রীতি পদ্ধতি নির্ধারিত হয়। বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টি এবং চুরি-ডাকাতির শাস্তি প্রবর্তিত হয়। মদ ও জুয়াকে চূড়ান্তভাবে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়। কসম ভাঙার কাফ্‌ফারা নির্ধারিত হয়। সাক্ষ্য প্রদান আইনের আরো কয়েকটি ধারা প্রবর্তন করা হয়।

দুইঃ মুসলমানদেরকে উপদেশ প্রদান। এখন মুসলমানরা একটি শাসক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে যাওয়ায় তাদের হাতে ছিল শাসন শক্তি। এর নেশায় বহু জাতি পথভ্রষ্ট হয়। মজলুমীর যুগের অবসান ঘটতে যাচ্ছিল এবং তার চাইতে অনেকে বেশী কঠিন পরীক্ষার যুগে মুসলমানরা পদার্পণ করেছিল। তাই তাদেরকে সম্বোধন করে বারবার উপদেশ দেয়া হয়েছেঃ ন্যায়, ইনসাফ ও ভারসাম্যের নীতি অবলম্বন করো। তোমাদের পূর্ববর্তী আহ্লী কিতাবদের মনোভাব ও নীতি পরিহার করো। আল্লাহর আনুগত্য এবং তাঁর হুকুম ও আইন কানুন মেনে চলার যে অঙ্গীকার তোমরা করেছো তার ওপর অবিচল থাকো। ইহুদী ও খৃস্টানদের মতো তাঁর সীমালংঘন করে তাদের মতো একই পরিণতির শিকার হয়ো না। নিজেদের যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালার জন্য কিতাবের অনুসরণ করো। মুনাফিকী নীতি পরিহার করো।

তিনঃ ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে উপদেশ প্রদান। এ সময় ইহুদীদের শক্তি খর্ব হয়ে গেছে। উত্তর আরবের প্রায় সমস্ত ইহুদী জনপদ মুসলমানদের পদানত। এ অবস্থায় তাদের অনুসৃত ভ্রান্ত নীতি সম্পর্কে তাদেরকে আর একবার সতর্ক করে দেয়া হয়। তাদেরকে সত্য-সঠিক পথে আসার দাওয়াত দেয়া হয়। এ ছাড়া যেহেতু হোদায়বিয়ার চুক্তির কারণে সমগ্র আরবে ও আশপাশের দেশগুলোয় ইসলামের দাওয়াত প্রচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল তাই খৃস্টানদেরকেও ব্যাপকভাবে সম্বোধন করে তাদের বিশ্বাসের ভ্রান্তিগুলো জানিয়ে দেয়া হয় এবং শেষ নবীর প্রতি ঈমান আনার জন্য তাদেরকে আহবান জানানো হয়। যেসব প্রতিবেশী দেশে মূর্তিপূজারী ও অগ্নি উপাসক জাতির বসবাস ছিল সেসব দেশের অধিবাসীদেরকে সরাসরি সম্বোধন করা হয়নি। কারণ ইতিপূর্বে তাদের সমমনা আরবের মুশরিকদেরকে সম্বোধন করে মক্কায় যে হেদায়াত নাযিল হয়েছিল তা-ই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল।

۞ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْيَهُودَ وَٱلنَّصَـٰرَىٰٓ أَوْلِيَآءَ ۘ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍۢ ۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمْ فَإِنَّهُۥ مِنْهُمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهْدِى ٱلْقَوْمَ ٱلظَّـٰلِمِينَ
৫১) হে ঈমানদারগণ! ইহুদী ও খৃস্টানদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে কেউ তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পরিগণিত করে তাহলে সেও তাদের মধ্যেই গণ্য হবে। অব্যশ্যি আল্লাহ‌ জালেমদেরকে নিজের পথনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত রাখেন।
)
فَتَرَى ٱلَّذِينَ فِى قُلُوبِهِم مَّرَضٌۭ يُسَـٰرِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَىٰٓ أَن تُصِيبَنَا دَآئِرَةٌۭ ۚ فَعَسَى ٱللَّهُ أَن يَأْتِىَ بِٱلْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍۢ مِّنْ عِندِهِۦ فَيُصْبِحُوا۟ عَلَىٰ مَآ أَسَرُّوا۟ فِىٓ أَنفُسِهِمْ نَـٰدِمِينَ
৫২) তুমি দেখতে পাচ্ছো, যাদের অন্তরে মোনাফেকীর রোগ আছে তারা তাদের মধ্যেই তৎপর থাকে। তারা বলে, আমাদের ভয় হয়, আমরা কোন বিপদের কবলে না পড়ে যাই।৮৪ কিন্তু অচিরেই আল্লাহ‌ যখন তোমাদের চূড়ান্ত বিজয় দান করবেন অথবা নিজের পক্ষ থেকে অন্য কোন কথা প্রকাশ করবেন। ৮৫ তখন তারা নিজেদের অন্তরে লুকিয়ে রাখা এ মোনাফেকীর জন্য লজ্জিত হবে।
৮৪) তখনো পর্যন্ত আরবে কুফর ও ইসলামের দ্বন্দ্বের কোন মীমাংসা হয়নি। যদিও নিজের আনসারীদের কর্মতৎপরতা, সাধনা ও আত্মত্যাগের কারণে ইসলাম একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছিল তবুও বিরুদ্ধ শক্তিগুলোও ছিল প্রবল পরাক্রান্ত। ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা যেমন ছিল তেমনি কুফরের বিজয়ের সম্ভাবনাও ছিল। তাই মুসলমানদের মধ্যে যেসব মোনাফেক বিদ্যমান ছিল তারা ইসলামী দলের মধ্যে থেকেও ইহুদী ও খৃস্টানদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে চাইতো। তারা ভাবতো, ইসলাম ও কুফরের এ দ্বন্দ্বে যদি ইসলামের পরাজয় ঘটে যায় তাহলে তাদের জন্য যেন কোন একটা আশ্রয় স্থল অবশিষ্ট থাকে। এছাড়াও সে সময় আরবে খৃস্টান ও ইহুদীদের অর্থবল ছিল সবচেয়ে বেশী। মহাজনী ব্যবসায়ের বেশীর ভাগ ছিল তাদের হাতে। আরবের সবচেয়ে উর্বর ও শস্য শ্যামল ভূখণ্ড ছিল তাদের অধিকারে। তাদের সুদখোরীর জাল চারদিকে ছড়িয়ে ছিল। কাজেই অর্থনৈতিক কারণেও এ মোনাফেকরা তাদের সাথে নিজেদের আগের সম্পর্ক অটুট রাখতে চাইতো। তাদের ধারণা ছিল, ইসলাম ও কুফরের এ সংঘর্ষে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে আমরা যদি ইসলামের সাথে বর্তমানে বিরোধে ও যুদ্ধে লিপ্ত সম্প্রদায়গুলোর সাথে নিজেদের সম্পর্ক ছিন্ন করি, তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক দিয়েই এটা হবে আমাদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক।
৮৫) অর্থাৎ চূড়ান্ত বিজয়ের চাইতে কম পর্যায়ের এমন কোন জিনিস যার মাধ্যমে লোকদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, জয় পরাজয়ের চূড়ান্ত ফয়সালা ইসলামের পক্ষেই হবে।
)
وَيَقُولُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓا۟ أَهَـٰٓؤُلَآءِ ٱلَّذِينَ أَقْسَمُوا۟ بِٱللَّهِ جَهْدَ أَيْمَـٰنِهِمْ ۙ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ ۚ حَبِطَتْ أَعْمَـٰلُهُمْ فَأَصْبَحُوا۟ خَـٰسِرِينَ
৫৩) আর সে সময় ঈমানদাররা বলবে, এরা কি সে সব লোক যারা আল্লাহর নামে শক্ত কসম খেয়ে আমরা তোমাদের সাথে আছি বলে আশ্বাস দিতো? এদের সমস্ত কর্মকাণ্ড নষ্ট হয়ে গেছে এবং শেষ পর্যন্ত এরা ব্যর্থ মনোরথ হয়েছেন।৮৬
৮৬) অর্থাৎ ইসলামের বিধান মেনে চলতে গিয়ে তারা যা কিছু করলোঃ নামায পড়লো, রোযা রাখলো, যাকাত দিল, জিহাদে শরীক হলো, ইসলামী আইনের আনুগত্য করলো--এসব কিছুই এ জন্য নষ্ট হয়ে গেলো যে, ইসলামের ব্যাপারে তাদের মনে আন্তরিকতা ও একনিষ্ঠতা ছিল না এবং তারা সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে একমাত্র আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে একমাত্র তারই অনুগত বান্দায় পরিণত হয়ে যায়নি। বরং নিজেদের পার্থিব স্বার্থের কারণে তারা আল্লাহ ও তাঁর বিদ্রোহীদের মধ্যে নিজেদেরকে অর্ধেক অর্ধেক ভাগ করে রেখেছিল।
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِۦ فَسَوْفَ يَأْتِى ٱللَّهُ بِقَوْمٍۢ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُۥٓ أَذِلَّةٍ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى ٱلْكَـٰفِرِينَ يُجَـٰهِدُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَآئِمٍۢ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ ٱللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَآءُ ۚ وَٱللَّهُ وَٰسِعٌ عَلِيمٌ
৫৪) হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি দ্বীন থেকে ফিরে যায়, (তাহলে ফিরে যাক) , আল্লাহ‌ এমনিতর আরো বহু লোক সৃষ্টি করে দেবেন, যাদেরকে আল্লাহ‌ ভালবাসেন এবং তারা আল্লাহকে ভালবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে,৮৭ যারা আল্লাহর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করে যাবে এবং কোন নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না।৮৮ এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে চান তাকে দান করেন। আল্লাহ‌ ব্যাপক উপায় উপকরণের অধিকারী এবং তিনি সবকিছু জানেন।
৮৭) ‘মু’মিনদের ব্যাপারে কোমল’ হবার মানে হচ্ছে এই যে, এক ব্যক্তি ঈমানদারদের মোকাবিলায় কখনো শক্তি প্রয়োগ করবে না। তার বুদ্ধি, মেধা, যোগ্যতা, প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ, শারীরিক ক্ষমতা কোনটিই মুসলমানদেরকে দাবিয়ে রাখার, কষ্ট দেবার বা ক্ষতি করার জন্য ব্যবহার করবে না। মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে তাকে সবসময় একজন দয়ার্দ্র হৃদয়, কোমল স্বভাবের, দরদী ও ধৈর্যশীল মানুষ হিসেবেই দেখতে পায়।

‘কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর’ হবার মানে হচ্ছে, নিজের মজবুদ ঈমান, নিস্বার্থ ও একনিষ্ঠ দ্বীনদারী, অনমনীয় নীতিবাদিতা, চারিত্রিক শক্তি ও ঈমানী দূরদৃষ্টির কারণে একজন মু’মিন ইসলাম বিরোধীদের মোকাবিলায় পাহাড়ের মতো অটল হবে। নিজের স্থান থেকে তাকে এক চূলও নড়ানো যাবে না। ইসলাম বিরোধীরা কখনো তাকে নমনীয়, দোদ্যুল্যমান এবং অক্লেশে গলধঃকরণ কারার মতো খাদ্য মনে করতে পারবে না। যখনই তারা তার মুখোমুখি হয় তখনই টের পেয়ে যায় যে, এ আল্লাহর বান্দা মরে যেতে পারে কিন্তু কখনো কোন মূল্যে বিক্রি হতে পারে না এবং কোন চাপের সামনে নতি স্বীকারও করতে পারে না।

৮৮) অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের অনুসরণ করার ব্যাপারে তাঁর বিধানসমূহ কার্যকর করার ব্যাপারে এবং এ দ্বীনের দৃষ্টিতে যা সত্য তাকে সত্য এবং যা মিথ্যা তাকে মিথ্যা বলার ব্যাপারে সে আপোষহীন ও নির্ভীক। কারোর বিরোধিতা, নিন্দা, তিরস্কার, আপত্তি ও বিদ্রূপবানের সে পরোয়া করবে না। সাধারণ জনমত যদি ইসলামের প্রতিকূল হয় এবং ইসলামের পথে চলার অর্থ যদি সারা দুনিয়ার সামনে নিজেকে অপাংক্তেয় বানানো হয়ে থাকে তাহলেও সে সাচ্চাদিলে যে পথকে সত্য মনে করেছে সে পথেই চলতে থাকবে।
)
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱلَّذِينَ يُقِيمُونَ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤْتُونَ ٱلزَّكَوٰةَ وَهُمْ رَٰكِعُونَ
৫৫) আসলে তোমাদের বন্ধু হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং সেই ঈমানদাররা যারা নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহর সামনে বিনত হয়।
)