আর রহমান

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

প্রথম শব্দটিকেই এ সূরার নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। এভাবে বুঝানো হয়েছে যে, এটি সেই সূরা যা “আর-রাহমান” শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছে। তাছাড়া সূরার বিষয়বস্তুর সাথেও এ নামের গভীর মিল রয়েছে। কারণ এ সূরার মধ্যে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার রহমতের পরিচায়ক গুণাবলী ও তার বাস্তব ফলাফলের উল্লেখ করা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

তাফসীর বিশারদগণ সাধারণতঃ এ সূরাটিকে মক্কী সূরা বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইকরিমা ও কাতাদা থেকে কোন কোন হাদীসে একথা উদ্ধৃত হয়েছে যে, এ সূরা মদীনায় অবতীর্ণ তা সত্ত্বেও প্রথমত ঐ সব সম্মানিত সাহাবা থেকে আরো কিছু সংখ্যক হাদীসে বিপরীত বক্তব্যও উদ্ধৃত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ সূরার বিষয়বস্তু মদীনায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের তুলনায় মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের সাথে বেশী সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন কি বিষয়বস্তুর বিচারে এটি মক্কী যুগেরও একেবারে প্রথম দিকের বলে মনে হয়। তাছাড়া বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, এটি হিজরতের কয়েক বছর পূর্বে মক্কাতে নাযিল হয়েছিল। মুসনাদে আহমদে হযরত আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বর্ণনা করেছেনঃ কা’বা ঘরের যে কোণে হাজরে আসওয়াদ স্থাপিত আমি হারাম শরীফের মধ্যে সে কোণের দিকে মুখ করে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায পড়তে দেখেছি। তখনও পর্যন্ত আল্লাহর নির্দেশ فَاصْدَعْ بِمَا تُؤْمَرُ (তোমাকে যে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে তা প্রকাশ্যে বলে দাও) নাযিল হয়নি। সে নামাযে মুশরিকরা তাঁর মুখ থেকে فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ কথাটি শুনেছিল। এ থেকে জানা যায় যে, এ সূরাটি সূরা আল হিজরের পূর্বেই নাযিল হয়েছিল।

আল বাযযার, ইবনে জারীর, ইবনুল মুনযির, দারুকুতনী (ফীল আফরাদ, , ইবনে মারদুইয়া এবং আল খাতীব (ফিত তারীখ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে এ হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন যে, একবার রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করলেন অথবা এ সূরাটি তাঁর সামনে পাঠ করা হলো। পরে তিনি লোকদের বললেনঃ জিনরা তাদের রবকে যে জওয়াব দিয়েছিল তোমাদের নিকট থেকে সে রকম সুন্দর জওয়াব শুনছি না কেন? লোকেরা বললো, সে জওয়াব কি ছিল! নবী (সা.) বললেনঃ যখনই আমি আল্লাহর বাণী فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ পড়ছিলাম, জিনরা তার জবাবে বলেছিল لَابِشَئٍ مِّنْ نِعْمَةِ رَبِّنَا نُكَذِّبُ “আমরা আমাদের রবের কোন নিয়ামতকেই অস্বীকার করি না।”

তিরমিযী, হাকেম ও হাফেজ আবু বকর বায্যার হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে প্রায় অনুরূপ বিষয়বস্তু সম্বলিত হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাঁদের বর্ণনার ভাষা হচ্ছেঃ সূরা রাহমানের তিলাওয়াত শুনে লোকজন যখন চুপ করে থাকলো তখন নবী (সা.) বললেনঃ

لَقَدْ قَرَأْتُهَا عَلَى الْجِنِّ لَيْلَةَ الْجِنِّ فَكَانُوا أَحْسَنَ مَرْدُودًا مِنْكُمْ كُنْتُ كُلَّمَا أَتَيْتُ عَلَى قَوْلِهِ فَبِأَىِّ آلاَءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ قَالُوا لاَ بِشَىْءٍ مِنْ نِعَمِكَ رَبَّنَا نُكَذِّبُ فَلَكَ الْحَمْدُ-

“যে রাতে কুরআন শোনার জন্য জিনরা একত্রিত হয়েছিল, সে রাতে আমি জিনদের এ সূরা শুনিয়েছিলাম। তারা তোমাদের চেয়ে এর উত্তম জওয়াব দিচ্ছিল। যখনই আমি আল্লাহ তা’আলার এ বাণী শুনাচ্ছিলাম হে জিন ও মানুষ তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নিয়ামতকে অস্বীকার করবে” তখনই তারা জওয়াবে বলেছিলঃ হে আমাদের বর, আমরা তোমার কোন নিয়ামতকেই অস্বীকার করি না। সব প্রশংসা কেবল তোমারই।”

এ হাদীস থেকে জানা যায়, সূরা আহকাফে (২৯ থেকে ৩২ আয়াত) রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ থেকে জিনদের কুরআন শোনার যে ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেই সময় নবী (সা.) নামাযে সূরা আর রাহমান পাঠ করেছিলেন। এটা নবুয়াতের ১০ম বছরের ঘটনা। সে সময় নবী (সা.) তায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে “নাখলা” নামক স্থানে কিছু সময় অবস্থান করেছিলেন। যদিও অপর কিছু সংখ্যক হাদীসে বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জানা ছিল না যে, জিনেরা তাঁর নিকট থেকে কুরআন শরীফ শুনছে। বরং পরে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে এ কথা অবহিত করেছিলেন যে, জিনেরা তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শুনেছিলো কিন্তু আল্লাহ তা’আলা নবীকে (সা.) যেভাবে জিনদের কুরআন তিলাওয়াত শোনা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন অনুরূপভাবে তাঁকে একথাও জানিয়েছিলেন যে, কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময় তারা কি জওয়াব দিচ্ছিল। এরূপ হওয়াটা অযৌক্তিক ব্যাপার নয়।

এসব বর্ণনা থেকে শুধু এতটুকুই জানা যায় যে, সূরা আর রহমান, সূরা আল হিজর ও সূরা আহকাফের পূর্বে নাযিল হয়েছিল। এসব ছাড়া আমরা আরো একটি হাদীস দেখতে পাই যা থেকে জানা যায়, সূরা আর রহমান মক্কী যুগের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরা সমূহের একটি। ইবনে ইসহাক হযরত ‘উরওয়া ইবনে যুবায়ের থেকে এই মর্মে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, সাহাবা কিরাম একদিন পরস্পর আলোচনা করলেন কুরাইশরা তো প্রকাশ্যে কখনো কাউকে উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত করতে শুনেনি। আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে একবার অন্তত তাদেরকে এ পবিত্র বাণী শোনাতে পারে? হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেনঃ আমি এ কাজ করবো। সাহাবা কিরাম বললেনঃ তারা তোমার ওপর জুলুম করবে বলে আমাদের আশংকা হয়। আমাদের মতে, একাজ এমন কোন ব্যক্তির করা উচিত যার জ্ঞাতী-গোষ্ঠী শক্তিশালী। কুরাইশদের যদি তার অনিষ্ট করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায় তাহলে তার গোষ্ঠীর লোকেরা যেন তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। হযরত আবদুল্লাহ বললেন, আমাকেই একাজ করতে দাও আল্লাহ আমার হিফাজতকারী। পরে বেশ কিছু বেলা হলে তিনি হারাম শরীফে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কুরাইশ নেতারা সেই সময় নিজ নিজ মজলিসে বসেছিল। হযরত আবদুল্লাহ মাকামে ইবরাহীমে পৌঁছে উচ্চস্বরে সূরা আর রহমান তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। আবদুল্লাহ কি বলেছে কুরাইশরা প্রথমে তা বুঝার চেষ্টা করলো। পরে যখন তারা বুঝতে পারলো মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বাণী হিসেবে যেসব কথা পেশ করেন এটা সে কথা তখন তারা তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তার মুখের ওপর চপেটাঘাত করতে লাগলো। কিন্তু হযরত আবদুল্লাহ কোন পরোয়াই করলেন না। যতক্ষণ তাঁর সাধ্যে কুলালো ততক্ষণ তিনি তাদের কুরআন শুনিয়ে যেতে থাকলেন। পরিশেষে তিনি তাঁর ফুলে উঠা মুখ নিয়ে ফিরে আসলো সংগী-সাথীরা বললোঃ আমরা এ আংশকাই করেছিলাম। জবাবে তিনি বললেনঃ আল্লাহর দুশমনরা আমার কাছে আজকের চেয়ে অধিক গুরুত্বহীন আর কখনো ছিল না। তোমরা চাইলে আমি আগামীকাল আবার তাদেরকে কুরআন শোনাবো। সবাই বললো এ-ই যথেষ্ট হয়েছে। যা তারা আদৌ শুনতে চাইতো না তা তো তুমি শুনিয়ে দিয়েছো (সীরাতে ইবনে হিশাম, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা-৩৩৬, ।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

এটাই কুরআন মজীদের একমাত্র সূরা যার মধ্যে মানুষের সাথে পৃথিবীর অপর একটি স্বাধীন সৃষ্টি জিনদেরকেও সরাসরি সম্বোধন করা হয়েছে এবং উভয়কেই আল্লাহর কুদরতের পরিপূর্ণতা, তাঁর সীমা-সংখ্যাহীন দয়া ও অনুগ্রহ, তাঁর সামনে তাদের অক্ষমতা ও অসহায়ত্ব এবং তাঁর কাছে তাদের জবাবদিহির উপলব্ধী জাগ্রত করে তাঁর অবাধ্যতার অশুভ পরিণতি সম্পর্কে সাবধান করে দেয়া হয়েছে আর আনুগত্যের উত্তম ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে। যদিও পবিত্র কুরআনের কয়েকটি স্থানে এ বিষয়ে পরিষ্কার বক্তব্য রয়েছে যা থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, জিনরা ও মানুষের মত স্বাধীন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সম্পন্ন দায়িত্বশীল সৃষ্টি, যাদেরকে কুফরী ও ঈমান গ্রহণের এবং আনুগত্য করার ও অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যেও মানুষের মতই কাফের ও ঈমানদার এবং অনুগত ও অবাধ্য আছে। তাদের মধ্যেও এমন গোষ্ঠী আছে যারা নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম ও আসমানী কিতাবসমূহের ওপর ঈমান এনেছে। তবে এ সূরা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআন মজীদের দাওয়াত জিন ও মানুষ উভয়ের জন্য এবং নবীর (সা.) রিসালাত শুধু মানবজাতি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়।

এ সূরার শুরুতে মানুষকে লক্ষ্য করেই সম্বোধন করা হয়েছে। কারণ তারাই পৃথিবীর খিলাফত লাভ করেছে, তাদের মধ্যেই আল্লাহর রসূল এসেছেন। এবং তাদের ভাষাতেই আল্লাহর কিতাব নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু পরে ১৩ আয়াত থেকে মানুষ ও জিন উভয়কেই সমানভাবে সম্বোধন করা হয়েছে এবং উভয়ের সামনে একই দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।

সূরার বিষয়বস্তু ছোট ছোট বাক্যে একটি বিশেষ ক্রমানুসারে বর্ণিত হয়েছেঃ

১ থেকে ৪ পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে, এ কুরআন শিক্ষা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে এসেছে। এ শিক্ষার সাহায্যে তিনি মানব জাতির হিদায়াতের ব্যবস্থা করবেন এই তাঁর রহমতের স্বাভাবিক দাবী। কারণ বুদ্ধি বিবেচনা ও বোধশক্তি সম্পন্ন জীব হিসেবে তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন।

৫ থেকে ৬ আয়াতে বলা হয়েছে, গোটা-বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তা’আলার একক নির্দেশ ও কর্তৃত্বাধীনে চলেছে। আসমান ও যমীনের সব কিছুই তার কর্তৃত্বাধীন। এখানে দ্বিতীয় আর কারো কর্তৃত্ব চলছে না।

৭ থেকে ৯ আয়াতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা বিশ্ব-জাহানের গোটা ব্যবস্থাকে পূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্যসহ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ ব্যবস্থাপনার প্রকৃতি দাবি করে যে, এখানে অবস্থানকারীরাও তাদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতার সীমার মধ্যে সত্যিকার ভারসাম্য ও ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকুক এবং ভারসাম্য বিনষ্ট না করুক।

১০ থেকে ২৫ আয়াত পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার অসীম ক্ষমতার বিস্ময়কর দিক ও তার পূর্ণতা বর্ণনা করার সাথে সাথে জিন ও মানুষ তাঁর যেসব নিয়ামত ভোগ করছে সে দিকেও ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

২৬ থেকে ৩০ পর্যন্ত আয়াতে জিন ও মানব জাতিকে এ মহাসত্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, এই বিশ্ব-জাহানে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ-ই অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী নয় এবং ছোট বড় কেউ-ই এমন নেই যে তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে আল্লাহর মুখাপেক্ষী নয়। যমীন থেকে আসমান পর্যন্ত রাতদিন যা কিছু ঘটছে তা তাঁরই কর্তৃত্ব সংঘটিত হচ্ছে।

৩১ থেকে ৩৬ পর্যন্ত আয়াতে এ উভয় গোষ্ঠীকেই এই বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, সে সময় অচিরেই আসবে যখন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ জিজ্ঞাসাবাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে তোমরা কোথাও যেতে পারবে না। সবখানে আল্লাহর কর্তৃত্ব তোমাদের পরিবেষ্টন করে আছে। তার মধ্য থেকে বেরিয়ে সটকে পড়ার সাধ্য তোমাদের নেই। তাঁর কর্তৃত্বের গণ্ডি থেকে পালিয়ে যেতে পারবে বলে যদি তোমাদের মধ্যে অহমিকা সৃষ্টি হয়ে থাকে তাহলে একবার পালিয়ে দেখ।

৩৭ ও ৩৮ আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ জিজ্ঞাসাবাদ হবে কিয়ামতের দিন।

যেসব মানুষ ও জিন দুনিয়ায় আল্লাহ তা’আলার নাফরমানী করতো ৩৯ থেকে ৪৫ পর্যন্ত আয়াতে তাদের পরিণাম সম্পর্কে বলা হয়েছে।

যেসব সৎকর্মশীল মানুষ ও জিন পৃথীবিতে আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করেছে এবং একদিন আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে নিজের সব কাজের হিসেব দিতে হবে এ উপলব্ধি নিয়ে কাজ করেছে আখেরাতে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে যেসব পুরস্কার দিবেন, ৪৬ আয়াত থেকে সূরা শেষ পর্যন্ত সে সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

এ বক্তব্যের পুরোটাই বক্তৃতার ভাষায় পেশ করা হয়েছে। এটা একটা আবেগময় ও উচ্চমানের ভাষণ। এ ভাষণের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার অসীম শক্তির এক একটি বিস্মরয়কর দিক, তাঁর দেয়া নিয়ামতসমূহের এক একটি নিয়ামত, তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা ও পরাক্রমের এক একটি দিক এবং তার পুরস্কার ও শাস্তির ব্যাপক বিস্তৃত ক্ষেত্রসমূহের এক একটি জিনিস বর্ণনা করে জিন ও মানুষকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছে فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ الاء যে একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ তা আমরা পরে আলোচনা করবো। এ ভাষানের মধ্যে এ শব্দটিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত করা হয়েছে। জিন ও মানুষের উদ্দেশ্যে এ প্রশ্ন প্রত্যক ক্ষেত্রে স্থান কাল ও পাত্র ভেদে একটি বিশেষ অর্থ বহন করেছে।

سَنَفْرُغُ لَكُمْ أَيُّهَ ٱلثَّقَلَانِ
৩১) ওহে পৃথিবীর দুই বোঝা২৯ তোমাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমি অতি শীঘ্রই তোমাদের প্রতি একাগ্রভাবে মনোনিবেশ করবো।৩০
২৯) মূল আয়াতে ছাকালান ثقلان শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এর মূল ধাতু ثقلثقل অর্থ বোঝা। আর ثقل বলা হয় এমন বোঝাকে যা সওয়ারী বা বাহনের ওপর চাপানো হয়েছে ثقل শব্দের শাব্দিক অনুবাদ হবে “দুই বোঝা” এখানে এ শব্দটি জ্বীন ও মানুষকে বুঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, এ দু’টি জাতিকেও পৃথিবী পৃষ্ঠে বোঝা হিসেবে চাপানো হয়েছে এবং পূর্ব থেকে সেই সব জ্বীন ও মানুষকে উদ্দেশ্য করেই কথা বলা হচ্ছে, যারা তাদের রবের আনুগত্য ও দাসত্ব থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাছাড়া পরবর্তী ৪৫ আয়াতেও তাদেরকেই সম্বোধন করা হয়েছে। সেজন্য তাদেরকে ايها الثقلان বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ স্রষ্টা যেন তাঁর এই দু’টি অযোগ্য সৃষ্টিকে বলছেনঃ তোমরা যারা আমার পৃথিবীর ওপর বোঝা হয়ে আছ, তোমাদের সাথে বুঝাপড়ার জন্য অবসর গ্রহণ করবো।
৩০) এখন আল্লাহ‌ তা’আলা এমন ব্যস্ত যে এসব অবাধ্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করার অবকাশ তিনি পান না, একথার অর্থ তা নয়। প্রকৃতপক্ষে একথার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ‌ একটি বিশেষ সময়সূচী নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সেই সময়সূচী অনুসারে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তিনি এ পৃথিবীতে মানুষ ও জিনদের বংশের পর বংশ সৃষ্টি করতে থাকবেন এবং তাদেরকে পৃথিবীর এ পরীক্ষাগারে এনে কাজ করার সুযোগ দেবেন। তারপর একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার এ ধারা হঠাৎ বন্ধ করে দেয়া হবে এবং সে সময়ে বিদ্যমান সমস্ত জ্বীন ও মানুষকে একই সময়ে হঠাৎ ধ্বংস করে দেয়া হবে। তারপর মানব ও জিন উভয় জাতির জবাবদিহির জন্য তার কাছে আরো একটি সময় নির্দিষ্ট করা আছে। সেই সময় জ্বীন ও মানব জাতির সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ লোকদেরকে পুনরায় জীবিত করে একই সময় একত্রিত করা হবে। এ সময়সূচীর প্রতি লক্ষ রেখে বলা হয়েছে, এখনো আমি প্রথম পর্যায়ের কাজ করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ের সময় এখনো আসেনি। তাই তৃতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করার কোন প্রশ্নই আসে না। তবে ঘাবড়াবেন না। খুব শীঘ্রই সে সময়টি এসে যাচ্ছে যখন আমি তোমাদের খবর নেয়ার জন্য অবসর নেব। এখানে অবসরহীনতার অর্থ এই নয় যে, এখন কোন কাজ আল্লাহ‌ তা’আলাকে এমনভাবে ব্যস্ত রেখেছে যে, অন্য কাজ করার অবকাশই তিনি পাচ্ছেন না। বরং এর ধরন ও প্রকৃতি হচ্ছে, যেমন কেউ বিভিন্ন কাজ সম্পাদনের জন্য একটি সময়সূচী প্রস্তুত করে রেখেছেন এবং সেই অনুসারে যে কাজের সময় এখনো আসেনি সে কাজ সম্পর্কে বলছেন, আমি সে কাজের জন্য আদৌ প্রস্তুত নই।
فَبِأَىِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
৩২) (তারপর দেখবো) তোমরা তোমাদের রবের কোন্ কোন্ অনুগ্রহকে অস্বীকার করো?৩১
৩১) এখানে الاء শব্দটিকে “অসীম ক্ষমতা” অর্থেও গ্রহণ করা যেতে পারে। বক্তব্যের ধারাবাহিকতার প্রতি লক্ষ করলে আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে এ দু’টি অর্থই সঠিক বলে মনে হয়। একটি অর্থগ্রহণ করলে তার সারকথা দাঁড়ায় এই যে, আজ তোমরা আমার নিয়ামতের নাশোকরী করছো এবং কুফর, শিরক, নাস্তিকতা, পাপাচার ও নাফরমানীর বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে নানা রকমের নেমকহারামী করে চলেছো। কিন্তু কাল যখন জবাবদিহির পালা আসবে তখন দেখবো আমার কোন কোন নিয়ামতকে তোমরা আকস্মিক দুর্ঘটনা কিংবা নিজেদের যোগ্যতার ফল বা কোন দেব-দেবী অথবা বুযুর্গের অনুগ্রহের দান বলে প্রমাণ করো। অন্য অর্থটি গ্রহণ করলে তার সারমর্ম দাঁড়ায় এই যে, আজ তোমরা কিয়ামত, হাশর-নাশর, হিসেব-নিকেশ এবং জান্নাত ও জাহান্নাম নিয়ে হাসি-তামাশা ও ঠাট্রা-বিদ্রূপ করছো এবং নিজ থেকেই এ অমূলক ধারণা নিয়ে বসে আছ যে, এরূপ হওয়া সম্ভবই নয়। কিন্তু আমি যখন তোমাদেরকে পরিবেষ্ঠিত করে ধরে আনবো এবং আজ যা তোমরা অস্বীকার করছো তা সবই তোমাদের সামনে এসে হাজির হবে সে সময় আমি দেখে নেব তোমরা আমার কোন কোন অসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করে থাকো।
يَـٰمَعْشَرَ ٱلْجِنِّ وَٱلْإِنسِ إِنِ ٱسْتَطَعْتُمْ أَن تَنفُذُوا۟ مِنْ أَقْطَارِ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ فَٱنفُذُوا۟ ۚ لَا تَنفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَـٰنٍۢ
৩৩) হে জ্বীন ও মানব গোষ্ঠী, তোমরা যদি পৃথিবী ও আকাশ মণ্ডলের সীমা পেরিয়ে কোথাও পালিয়ে যেতে পার তাহলে গিয়ে দেখ। পালাতে পারবে না, এ জন্য বড় শক্তি প্রয়োজন। ৩২
৩২) যমীন ও আসমান অর্থ গোটা সৃষ্টিজগত অথবা অন্য কথায় আল্লাহর প্রভুত্ব। আয়াতের অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়ার সাধ্য তোমাদের নেই। যে জবাবদিহি সম্পর্কে তোমাদের অবহিত করা হচ্ছে তার সময় যখন আসবে তখন তোমরা যেখানেই থাক না কেন পাকড়াও করে আনা হবে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তোমাদেরকে আল্লাহর প্রভুত্বাধীন এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। কিন্তু সে ক্ষমতা তোমাদের নেই। তোমরা যদি মনে এ ধরনের অহমিকা পোষণ করে থাক তাহলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে দেখ।
فَبِأَىِّ ءَالَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ
৩৪) তোমরা তোমাদের রবের কোন্ কোন্ অসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করবে?
)
يُرْسَلُ عَلَيْكُمَا شُوَاظٌۭ مِّن نَّارٍۢ وَنُحَاسٌۭ فَلَا تَنتَصِرَانِ
৩৫) (যদি পালানেরা চেষ্টা করো তাহলে) তোমাদের প্রতি আগুনের শিখা এবং ধোঁয়া৩৩ ছেড়ে দেয়া হবে তোমরা যার মোকাবিলা করতে পারবে না।
৩৩) মূল আয়াতে شواظنحاس শব্দ দু’টি ব্যবহৃত হয়েছে। এমন নিরেট অগ্নি-শিখাকে شواظ বলা হয় যার মধ্যে ধোঁয়া থাকে না আর এমন নিরেট ধোঁয়াকে (نحاس বলা হয় যার মধ্যে অগ্নিশিখা থাকে না। জ্বীন ও মানুষ যখন আল্লাহ‌ তা’আলার সামনে জবাবদিহি থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করবে তখন তাদের প্রতি একের পর এক এ দু’টি জিনিস নিক্ষেপ করা হবে।
)