ইউনুস

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

যথারীতি ৯৮ আয়াত থেকে নিছক আলামত হিসেবে এ সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ আয়াতের প্রসংগক্রমে হযরত ইউনুস আলাইহিস সালামের কথা এসেছে কিন্তু মূলত ও সূরার আলোচ্য বিষয় হযরত ইউনুসের কাহিনী নয়।

নাযিল হওয়ার স্থান

এ গোটা সূরাটি মক্কা মুয়াযযামায় নাযিল হয়। হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত। সূরার বিষয়বস্তু এ বক্তব্য সমর্থন করে। কেউ কেউ মনে করেন এর কিছু আয়াত মাদানী যুগে নাযিল হয়। কিন্তু এটা শুধুমাত্র একটি হাওয়াই অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। বক্তব্যের ধারাবাহিক উপস্থাপনা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার অনুভূত হয়, এগুলো একাধিক ভাষণ বা বিভিন্ন সময় নাযিলকৃত বিভিন্ন আয়াতের সমষ্টি নয়। বরং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এটা একটি সুবিন্যস্ত ও সুসংবদ্ধ ভাষণ। এটা সম্ভবত এক সাথে নাযিল হয়ে থাকবে এবং এর বক্তব্য বিষয় একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, এটা মক্কী যুগের সূরা।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল

এ সূরাটি কখন নাযিল হয়, এ সম্পর্কিত কোন হাদীস আমরা পাইনি। কিন্তু এর বক্তব্য বিষয় থেকে বুঝা যায় এ সুরাটি রাসূলুল্লাহ (সা., মক্কায় অবস্থানের শেষের দিকে নাযিল হয়ে থাকবে। কারণ এর বক্তব্য বিষয় থেকে সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, এসময় ইসলামী দাওয়াতের বিরোধীদের পক্ষ থেকে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কাজ প্রচণ্ড ভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে নবী ও তার অনুসারীদেরকে আর বরদাশত করতে রাযী নয়। উপদেশ অনুরোধের মাধ্যমে তারা সঠিক পথে চলবে, এমন আশা করা যায় না। নবী চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করার ফলে তাদের যে অনিবার্য পরিণতির সম্মুখীন হওয়ার কথা। এখন তা থেকে তাদের সতর্ক করে দেয়ার সময় এসে গেছে। কোন ধরনের সূরা মক্কার শেষ যুগের সাথে সম্পর্ক রাখে বক্তব্য বিষয়ের এ বৈশিষ্ট্যই তা আমাদের জানিয়ে দেয়। কিন্তু এ সূরায় হিজরতের প্রতি কোন ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। তাই যেসব সূরা থেকে আমরা হিজরতের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বা অস্পষ্ট কোন না কোন ইঙ্গিত পাই এ সূরাটির যুগ সেগুলো থেকে আগের মনে করতে হবে। এ সময় কাল চিহ্নিত করার পর ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করার প্রয়োজন থাকে না। কারণ, সূরা আনআম ও সূরা আরাফের ভূমিকায় এ যুগের ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে।

বিষয়বস্তু

এ ভাষণের বিষয়বস্তু হচ্ছে, দাওয়াত দেয়া, বুঝানো, ও সতর্ক করা। ভাষণের শুরু হয়েছে এভাবেঃ

একজন মানুষ নবুয়াতের বানী প্রচার করেছে। তা দেখে লোকেরা অবাক হচ্ছে। তারা অযথা তার বিরুদ্ধে যাদুকারিতার অভিযোগ আনছে। অথচ যেসব কথা সে পেশ করেছে তার মধ্যে আজব কিছুই নেই এবং যাদু ও জ্যোর্তিবিদ্যার সাথে সম্পর্ক রাখে এমন কোন বিষয়ও তাতে নেই। সে তো দুটো গুরুত্বপূর্ণ সত্য তোমাদের জানিয়ে দিচ্ছে। এক, যে আল্লাহ এ বিশ্ব জাহানের স্রষ্টা এবং যিনি কার্যত এর ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেছেন একমাত্র তিনিই তোমাদের মালিক ও প্রভু এবং একমাত্র তিনিই তোমাদের বন্দেগী ও আনুগত্য লাভের অধিকার রাখেন। দুই, বর্তমান পার্থিব জীবনের পরে আর একটি জীবন আসবে। সেখানে তোমাদের পুনর্বার সৃষ্টি করা হবে। সেখানে তোমরা নিজেরদের বর্তমান জীবনের যাবতীয় কাজের হিসেব দেবে। একটি মৌলিক প্রশ্নের ভিত্তিতে তোমরা শাস্তি বা পুরষ্কার লাভ করবে। সে প্রশ্নটি হচ্ছে, তোমরা আল্লাহকে নিজেদের প্রভু মেনে নিয়ে তা ইচ্ছা অনুযায়ী সৎকাজ করছো না তার বিপরীত কাজ করছো? তিনি তোমাদের সামনে এই যে সত্য দুটি পেশ করেছেন এ দুটি যথার্থ ও অকাট্য বাস্তব সত্য। তোমাদের মানা নামানায় এর কিছু আসে যায় না। এ সত্য তোমাদেরকে আহবান জানাচ্ছে, যে একে মেনে নিয়ে সেই অনুযায়ী তোমরা নিজেদের জীবন গড়ে তোলো। তার এ আহবানে সাড়া দিলে তোমাদের পরিণাম ভাল হবে। অন্যথায় দেখবে নিজেদের অশুভ পরিণতি।

আলোচনার বিষয়াদি

এ প্রাথমিক আলোচনার পর নিম্নোক্ত বিষয়গুলো একটি বিশেষ ধারাবাহিকতা সহাকরে সামনে আসেঃ

একঃ যারা অন্ধ বিদ্বেষ ও গোঁড়ামিতে লিপ্ত হয় না এবং আলোচনায় হারজিতের পরিবর্তে নিজেরা ভুল দেখা ও ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বাঁচার চিন্তা করে তাদের বুদ্ধি- বিবেককে আল্লাহর একত্ব ও পরকালীন জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত করার মতো যুক্তি প্রমাণাদি।

দুইঃ লোকদের তাওহীদ ও রিসালাতের আকীদা স্বীকার করে নেয়ার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে যেসব বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল সেগুলো দূর করা এবং যেসব গাফলতি সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া।

তিনঃ মুহম্মাদ (সা.) এর রিসালাত এবং তিনি যে বাণী এনেছিলেন সেসব সম্পর্কে যে সন্দেহ ও আপত্তি পেশ করা হতো, তার যথাযথ জবাব দান।

চারঃ পরবর্তী জীবনে যা কিছু ঘটবে সেগুলো আগেভাগেই জানিয়ে দেয়া, যাতে মানুষ সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে নিজের কার্যকলাপ সংশোধন করে নেয় এবং পরে আর তাকে সে জন্য আফসোস করতে না হয়।

পাঁচঃ এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া যে, এ দুনিয়ার বর্তমান জীবন আসলে একটি পরীক্ষার জীবন। এ পরীক্ষার জন্য তোমাদের যে অবকাশ দেয়া হয়েছে তা শুধুমাত্র ততটুকুই যতটুকু সময় তোমরা এ দুনিয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছো। এ সময়টুকু যদি তোমরা নষ্ট করে দাও এবং নবীর হেদায়াত গ্রহণ করে পরীক্ষায় সাফল্য লাভের ব্যবস্থা না করো, তাহলে তোমরা আর দ্বিতীয় কোন সুযোগ পাবে না। এ নবীর আগমন এবং এ কুরআনের মাধ্যমে তোমাদের কাছে সত্য জ্ঞান পৌঁছে যাওয়া তোমাদের পাওয়া একমাত্র ও সর্বোত্তম সুযোগ। একে কাজে লাগাতে না পারলে পরবর্তী জীবনে তোমাদের চিরকাল পস্তাতে হবে।

ছয়ঃ এমন সব সুস্পষ্ট অজ্ঞতা, মূর্খতা, ও বিভ্রান্তি চিহ্নিত করা, যা শুধুমাত্র আল্লাহর হেদায়াত ছাড়া জীবন যাপন করার কারণেই লোকদের জীবনে সৃষ্টি হচ্ছিল।

এ প্রসঙ্গে নূহ (আ) ঘটনা সংক্ষেপে এবং মূসা (আ) ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। চারটি কথা অনুধাবন করানোই এ ইতিহাস বর্ণনার উদ্দেশ্য।

প্রথমত, মুহাম্মাদ (সা.) এর সাথে তোমরা যে ব্যবহার করছো তা নূহ (আ) ও মূসার(আ) সাথে তোমাদের পূর্ববর্তীরা যে ব্যবহার করছে অবিকল তার মতই। আর নিশ্চিত থাকো যে, এ ধরনের কার্যকলাপের যে পরিণতি তারা ভোগ করেছে তোমরাও সেই একই পরিণতির সম্মুখীন হবে। দ্বিতীয়ত, মুহাম্মাদ (সা.) ও তার সাথীদের আজ তোমরা যে অসহায়ত্ব ও দুর্বল অবস্থার মধ্যে দেখছো তা থেকে একথা মনে করে নিয়ো না যে, অবস্থা চিরকাল এ রকমই থাকবে। তোমরা জানো না, যে আল্লাহ মূসা ও হারূনের পেছনে ছিলেন এদের পেছনেও তিনিই আছেন। আর তিনি এমনভাবে গোটা পরিস্থিতি পাল্টে দেন যা কেউ চিন্তাও করতে পারে না। তৃতীয়ত, নিজেদের শুধরে নেয়ার জন্য আল্লাহ তোমাদের যে অবকাশ দিচ্ছেন তা যদি তোমরা নষ্ট করে দাও এবং তারপর ফেরাউনের মতো আল্লাহর হাতে পাকড়াও হবার পর একেবারে শেষ মুহূর্তে তাওবা করো, তাহলে তোমাদের মাফ করা হবে না।চতুর্থত, যারা মুহাম্মাদ (সা.) এর ওপর ঈমান এনেছিল তারা যেন প্রতিকূল পরিবেশের চরম কঠোরতা ও তার মোকাবিলায় নিজেদের অসহায়ত্ব দেখে হতাশ হয়ে না পড়ে। তাদের জানা উচিত, এ অবস্থায় তাদের কিভাবে কাজ করতে হবে। তাদের এ ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে যে, আল্লাহ যখন নিজের মেহেরবানীতে তাদেরকে এ অবস্থা থেকে উদ্ধার করবেন তখন যেন তারা বনী ইসরাঈল মিসর থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে আচরণ করেছিল তেমন আচরণ না করে।

সবশেষে ঘোষণা করা হয়েছেঃ এ আকীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী এবং এ পথ ও নীতির ভিত্তিতে এগিয়ে চলার জন্য আল্লাহ তার নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সামান্যতমও কাটছাট করা যেতে পারে না। যে ব্যক্তি এটা গ্রহণ করবে সে নিজের ভাল করবে এবং যে একে বর্জন করে ভুল পথে পা বাড়াবে সে নিজেরই ক্ষতি করবে।

وَمَا يَتَّبِعُ أَكْثَرُهُمْ إِلَّا ظَنًّا ۚ إِنَّ ٱلظَّنَّ لَا يُغْنِى مِنَ ٱلْحَقِّ شَيْـًٔا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ عَلِيمٌۢ بِمَا يَفْعَلُونَ﴿٣٦ وَمَا كَانَ هَـٰذَا ٱلْقُرْءَانُ أَن يُفْتَرَىٰ مِن دُونِ ٱللَّهِ وَلَـٰكِن تَصْدِيقَ ٱلَّذِى بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ ٱلْكِتَـٰبِ لَا رَيْبَ فِيهِ مِن رَّبِّ ٱلْعَـٰلَمِينَ﴿٣٧ أَمْ يَقُولُونَ ٱفْتَرَىٰهُ ۖ قُلْ فَأْتُوا۟ بِسُورَةٍۢ مِّثْلِهِۦ وَٱدْعُوا۟ مَنِ ٱسْتَطَعْتُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ صَـٰدِقِينَ﴿٣٨ بَلْ كَذَّبُوا۟ بِمَا لَمْ يُحِيطُوا۟ بِعِلْمِهِۦ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُۥ ۚ كَذَٰلِكَ كَذَّبَ ٱلَّذِينَ مِن قَبْلِهِمْ ۖ فَٱنظُرْ كَيْفَ كَانَ عَـٰقِبَةُ ٱلظَّـٰلِمِينَ﴿٣٩ وَمِنْهُم مَّن يُؤْمِنُ بِهِۦ وَمِنْهُم مَّن لَّا يُؤْمِنُ بِهِۦ ۚ وَرَبُّكَ أَعْلَمُ بِٱلْمُفْسِدِينَ﴿٤٠
(৩৬) আসলে তাদের বেশীরভাগ লোকই নিছক আন্দাজ-অনুমানের পেছনে চলছে।৪৪ অথচ আন্দাজ-অনুমান দ্বারা সত্যের প্রয়োজন কিছুমাত্র মেটে না। তারা যা কিছু করছে তা আল্লাহ‌ ভালভাবেই জানেন। (৩৭) আর এ কুরআন আল্লাহর অহী ও শিক্ষা ছাড়া রচনা করা যায় না। বরং এ হচ্ছে যা কিছু আগে এসেছিল তার সত্যায়ন এবং আল কিতাবের বিশদ বিবরণ।৪৫ এতে কোন সন্দেহ নেই যে, এটি বিশ্বজাহানের অধিকর্তার পক্ষ থেকে এসেছে। (৩৮) তারা কি একথা বলে, পয়গম্বর নিজেই এটা রচনা করেছে? বলো, “তোমাদের এ দোষারোপের ব্যাপারে তোমরা যতি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে এরই মতো একটি সূরা রচনা করে আনো এবং এক আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাকে ডাকতে পারো সাহায্যের জন্য ডেকে নাও”৪৬ (৩৯) আসল ব্যাপার হচ্ছে, যে জিনিসটি এদের জ্ঞানের আওতায় আসেনি এবং যার পরিমাণও এদের সামনে নেই তাকে এরা (অনর্থক আন্দাজে) মিথ্যা বলে।৪৭ এমনি ভাবে এদের আগের লোকেরাও মিথ্যা আরোপ করেছে। কাজেই দেখো জালেমদের পরিণাম কী হয়েছে! (৪০) তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক ঈমান আনবে এবং কিছু লোক ঈমান আনবে না। আর তোমার রব এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে ভালভাবেই জানেন।৪৮
৪৪) অর্থাৎ যারা বিভিন্ন ধর্ম প্রবর্তন করেছে, দর্শন রচনা করেছে এবং জীবন বিধান তৈরী করেছে, তারাও এসব কিছু জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় বরং আন্দাজ অনুমানের ভিত্তিতে করেছে। আর যারা এসব ধর্মীয় ও দ্বীনি নেতৃবৃন্দের আনুগত্য করেছে তারাও জেনে বুঝে নয় বরং নিছক অনুমানের ভিত্তিতে তাদের পেছনে চলেছে। কারণ তরা মনে করে, এত বড় বড় লোকেরা যখন একথা বলেন এবং আমাদের বাপ দাদারা এসব মেনে আসছেন আবার এ সঙ্গে দুনিয়ার বিপুলসংখ্যক লোক এগুলো মেনে নিয়ে এ অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে তখন নিশ্চয়ই এই লোকেরা ঠিক কথাই বলে থাকবেন।
৪৫) যা কিছু আগে এসে গিয়েছিল তার সত্যায়ণ-অর্থাৎ শুরু থেকে নবীদের মাধ্যমে মানুষকে যে মৌলিক শিক্ষা দান করা হতে থাকে এ কুরআন তা থেকে সরে গিয়ে কোন নতুন জিনিস পেশ করছে না। বরং তার সত্যতা প্রমাণ করছে এবং তাকে পাকাপোক্ত করছে। যদি এটা কোন নতুন ধর্মপ্রবর্তকের মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতার ফসল হতো, তাহলে অবশ্যই এর মধ্যে পুরাতন সত্যগুলোর সাথে কিছু নিজের অভিনব বক্তব্য মিশিয়ে দিয়ে এর একটা অভিনব ও বিশিষ্ট চরিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যেতো।

আল কিতাবের বিশদ বিবরণ-অর্থাৎ সমস্ত আসমানী কিতাবের সারমর্ম যে মৌলিক শিক্ষাবলীর সমষ্টি, সেগুলো এর মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে যুক্তি প্রমাণ সহকারে উপদেশ দান ও বুঝাবার ভঙ্গিতে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং বাস্তব অবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে।

৪৬) সাধারণভাবে লোকেরা এ চ্যালেঞ্জটিকে নিছক কুরআনের ভাষা শৈলী অহংকার ও সাহিত্য সুষমার দিক দিয়ে ছিল বলে মনে করে। কুরআনের অলৌকিকতার ওপর যেভাবে আলোচনা করা হয়েছে তার ফলে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কুরআন যে, তার অনন্য ও অতুলনীয় হবার দাবীর ভিত্তি নিছক নিজের শাব্দিক সৌন্দর্য সুষমার ওপর প্রতিষ্ঠিত করেনি, এ ধরনের সীমিত ব্যাপার থেকে কুরআনের মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। নিঃসন্দেহে ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও কুরআন নজিরবিহীন। কিন্তু মূলত যে জিনিসটির ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, কোন মানবিক মেধা ও প্রতিভা এহেন কিতাব রচনা করতে পারে না, সেটি হচ্ছে তার বিষয়বস্তুও শিক্ষা। এর মধ্যে অলৌকিকতার যেসব দিক রয়েছে এবং যেসব কারণে বলা যায় যে, এটি নিঃসন্দেহে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল করা কিতাব এবং কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের কিতাব রচনা করা অসম্ভব তা এ কুরআনেরই বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা করে দেয়া হয়েছে। এ ধরনের বর্ণনা ইতিপূর্বে যেখানেই এসেছে সেখানে আমরা তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এসেছি এবং পরবর্তীতেও করে যেতে থাকবো। তাই কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় এখানে এর আলোচনা করা হলো না। (ব্যাখ্যার জন্য দেখুন আত-তুর টীকা ২৬, ২৭)।
৪৭) কুরআনকে মিথ্যা সাব্যস্ত করার দু’টি ভিত্তি হতে পারতো। গবেষণা করে তথ্য প্রমাণাদির মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে জানা যেতো যে, এটি বানোয়াট ও নকল। অথবা এতে যে সত্য বর্ণনা করা হয়েছে এবং যে খবর দেয়া হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তার ভিত্তিতে এ মিথ্যা সাব্যস্ত করণকে যুক্তিসঙ্গত মনে করা যেতো। কিন্তু মিথ্যা সাব্যস্ত করার এ দু’টি কারণের মধ্য থেকে কোন একটি কারণও এখানে বর্তমান নেই। কোন ব্যক্তি একথা বলতে পারে না যে, এ কিতাবটি কেউ নিজে তৈরী করে আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে, একথা সে তথ্য-জ্ঞানের ভিত্তিতে জানে। কেউ অদৃশ্যের পরদা উন্মোচন করে ভিতরে উকি দিয়ে দেখেও নেয়নি যে, সত্যিই সেখানে বহুসংখ্যক খোদা রয়েছে এবং এ কিতাবটিতে অনর্থক শুধুমাত্র একজন ইলাহর কথা শুনানো হচ্ছে। অথবা আসলে আল্লাহ‌ ফেরেশতা অহী ইত্যাদির কোন সত্যতাই নেই এবং এ কিতাবে অযথা এসব গালগল্প বানিয়ে নেয়া হয়েছে। কেউ মরে গিয়েও দেখে নেয়নি যে এ কিতাবে বর্ণিত পরকালীন জীবন এবং তার হিসাব নিকাশ ও শাস্তি-পুরস্কারের সমস্ত কাহিনীই মিথ্যা। কিন্তু এ সত্ত্বেও নিছক সন্দেহ ও ধারণার ভিত্তিতে এমনভাবে একে মিথ্যা বলা হচ্ছে যে, তাতে মনে হয় যেন এটি যে নকল ও মিথ্যা তা তাত্ত্বিকভাবেই চূড়ান্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে স্থিরিকৃত হয়ে গেছে।
৪৮) যারা ঈমান আনে না তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, আল্লাহ‌ এ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে খুব ভাল করেই জানেন। অর্থাৎ নবীর কথা আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না বলে সদিচ্ছা সহকারেই আমরা তা মেনে নিতে পারছি না। এরূপ অজুহাত দিয়ে তারা দুনিয়া বাসীর মুখ বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু মনের গোপন কথা যিনি জানেন সেই আল্লাহ‌ তাদের প্রতিটি ব্যক্তি সম্পর্কে জানেন, সে কিভাবে নিজের হৃদয় ও মস্তিষ্কের দরজায় তালা এটে দিয়েছে, নিজেই নিজেকে গাফলতির সাগরে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজের বিবেকের কণ্ঠরোধ করেছে, নিজের অন্তরে সত্যের সাক্ষ্যকে দমিয়ে দিয়েছে এবং নিজের মস্তিষ্ক থেকে সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্যতার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। সে শুনেও শোনেনি। বুঝেও না বুঝার ভান করেছে। সত্যের মোকাবিলায় নিজের অন্ধ বিদ্বেষকে নিজের পার্থিব স্বার্থকে নিজের বাতিলের সাথে সংঘর্ষ মুখর স্বার্থকে এবং নিজের নফসানী খাহেশ ও আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েছে। তাই সে নিষ্পাপ ভ্রষ্টাচারী নয় বরং প্রকৃত অর্থে বিপর্যয়কারী।