বনী ইসরাঈল

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

চার নম্বর আয়াতের অংশ বিশেষ (আরবী------------------------------------) থেকে বনী ইস্রাঈল নাম গৃহীত হয়েছে। বনী ইস্রাঈল এই সূরার আলোচ্য বিষয় নয়। বরং এ নামটিও কুরআনের অধিকাংশ সূরার মতো প্রতীক হিসেবেই রাখা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

প্রথম আয়াতটিই একথা ব্যক্ত করে দেয় যে, মি’রাজের সময় এ সূরাটি নাযিল হয়। হাদীস ও সীরাতের অধিকাংশ কিতাবের বর্ণনা অনুসারে হিজরাতের এক বছর আগে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাই এ সূরাটিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কায় অবস্থানের শেষ যুগে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত।

পটভূমি

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহীদের আওয়াজ বুলন্দ করার পর তখন ১২ বছর অতীত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর পথ রুখে দেবার জন্য তাঁর বিরোধীরা সব রকমের চেষ্টা করে দেখেছিল। তাদের সকল প্রকার বাধা-বিপত্তির দেয়াল টপকে তাঁর আওয়াজ আরবের সমস্ত এলাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। আরবের এমন কোন গোত্র ছিল না যার দু’চার জন লোক তাঁর দাওয়াতে প্রভাবিত হয়নি। মক্কাতেই আন্তরিকতা সম্পন্ন লোকদের এমন একটি ছোট্ট দল তৈরী হয়ে গিয়েছিল যারা এ সত্যের দাওয়াতের সাফল্যের জন্য প্রত্যেকটি বিপদ ও বাধা-বিপত্তির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। মদীনায় শক্তিশালী আওস ও খাযরাজ গোত্র দু’টির বিপুল সংখ্যক লোক তার সমর্থকে পরিণত হয়েছিল। এখন তাঁর মক্কা থেকে মদীনায় স্থানান্তরিত হয়ে বিক্ষিপ্ত মুসলমানদেরকে এক জায়গায় একত্র করে ইসলামের মূলনীতিসমূহের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সময় ঘনিয়ে এসেছিল এবং অতিশীঘ্রই তিনি এ সুযোগ লাভ করতে যাচ্ছিলেন।

এহেন অবস্থায় মি’রাজ সংঘটিত হয়। মি’রাজ থেকে ফেরার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াবাসীকে এ পয়গাম শুনান।

বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়

এ সূরায় সতর্ক করা, বুঝানো ও শিক্ষা দেয়া এ তিনটি কাজই একটি আনুপাতিক হারে একত্র করে দেয়া হয়েছে।

সতর্ক করা হয়েছে মক্কার কাফেরদেরকে। তাদেরকে বলা হয়েছে, বনী ইসরাঈল ও অন্য জাতিদের পরিণাম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো। আল্লাহর দেয়া যে অবকাশ খতম হবার সময় কাছে এসে গেছে তা শেষ হবার আগেই নিজেদেরকে সামলে নাও। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কুরআনের মাধ্যমে যে দাওয়াত পেশ করা হচ্ছে তা গ্রহণ করো। অন্যথায় তোমাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে এবং তোমাদের জায়গায় অন্য লোকদেরকে দুনিয়ায় আবাদ করা হবে। তাছাড়া হিজরতের পর যে বনী ইস্রাঈলের উদ্দেশ্যে শীঘ্রই অহী নাযিল হতে যাচ্ছিল পরোক্ষভাবে তাদেরকে এভাবে সতর্ক করা হয়েছে যে, প্রথমে যে শাস্তি তোমরা পেয়েছো তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো এবং এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত লাভের পর তোমরা যে সুযোগ পাচ্ছো তার সদ্ব্যবহার করো। এ শেষ সুযোগটিও যদি তোমরা হারিয়ে ফেলো এবং এরপর নিজেদের পূর্বতন কর্মনীতির পুনরাবৃত্তি করো তাহলে ভয়াবহ পরিণামের সম্মুখীন হবে।

মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য এবং কল্যাণ ও অকল্যাণের ভিত্তি আসলে কোন্ কোন্ জিনিসের ওপর রাখা হয়েছে, তা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী পদ্ধতিতে বুঝানো হয়েছে। তাওহীদ, পরকাল, নবুওয়াত ও কুরআনের সত্যতার প্রমাণ পেশ করা হয়েছে। মক্কার কাফেরদের পক্ষ থেকে এ মৌলিক সত্যগুলোর ব্যাপারে যেসব সন্দেহ-সংশয় পেশ করা হচ্ছিল সেগুলো দূর করা হয়েছে। দলীল-প্রমাণ পেশ করার সাথে সাথে মাঝে মাঝে অস্বীকারকারীদের অজ্ঞতার জন্য তাদেরকে ধমকানো ও ভয় দেখানো হয়েছে।

শিক্ষা দেবার পর্যায়ে নৈতিকতা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির এমনসব বড় বড় মূলনীতির বর্ণনা করা হয়েছে যেগুলোর ওপর জীবনের সমগ্র ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াতের প্রধান লক্ষ্য। এটিকে ইসলামের ঘোষণাপত্র বলা যেতে পারে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছর আগে আরববাসীদের সামনে এটি পেশ করা হয়েছিল। এতে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, এটি একটি নীল নক্শা এবং এ নীল নক্শার ভিত্তিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের দেশের মানুষের এবং তারপর সমগ্র বিশ্ববাসীর জীবন গড়ে তুলতে চান।

এসব কথার সাথে সাথেই আবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হেদায়াত করা হয়েছে যে, সমস্যা ও সংকটের প্রবল ঘূর্ণাবর্তে মজবুতভাবে নিজের অবস্থানের ওপর টিকে থাকো এবং কুফরীর সাথে আপোষ করার চিন্তাই মাথায় এনো না। তাছাড়া মুসলমানরা যাদের মন কখনো কখনো কাফেরদের জুলুম, নিপীড়ন, কূটতর্ক এবং লাগাতার মিথ্যাচার ও মিথ্যা দোষারোপের ফলে বিরক্তিতে ভরে উঠতো, তাদেরকে ধৈর্য ও নিশ্চিন্ততার সাথে অবস্থার মোকাবিলা করতে থাকার এবং প্রচার ও সংশোধনের কাজে নিজেদের আবেগ-অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপদেশ দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আত্মসংশোধন ও আতসংযমের জন্য তাদেরকে নামাযের ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এটি এমন জিনিস যা তোমাদের সত্যের পথের মুজাহিদদের যেসব উন্নত গুণাবলীতে বিভূষিত হওয়া উচিত তেমনি ধরনের গুণাবলীতে ভূষিত করবে। হাদীস থেকে জানা যায়, এ প্রথম পাঁচ ওয়াক্ত নামায মুসলমানদের ওপর নিয়মিতভাবে ফরয করা হয়।

وَلَا تَقْتُلُوٓا۟ أَوْلَـٰدَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلَـٰقٍۢ ۖ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُمْ ۚ إِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْـًۭٔا كَبِيرًۭا﴿٣١ وَلَا تَقْرَبُوا۟ ٱلزِّنَىٰٓ ۖ إِنَّهُۥ كَانَ فَـٰحِشَةًۭ وَسَآءَ سَبِيلًۭا﴿٣٢ وَلَا تَقْتُلُوا۟ ٱلنَّفْسَ ٱلَّتِى حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلْحَقِّ ۗ وَمَن قُتِلَ مَظْلُومًۭا فَقَدْ جَعَلْنَا لِوَلِيِّهِۦ سُلْطَـٰنًۭا فَلَا يُسْرِف فِّى ٱلْقَتْلِ ۖ إِنَّهُۥ كَانَ مَنصُورًۭا﴿٣٣ وَلَا تَقْرَبُوا۟ مَالَ ٱلْيَتِيمِ إِلَّا بِٱلَّتِى هِىَ أَحْسَنُ حَتَّىٰ يَبْلُغَ أَشُدَّهُۥ ۚ وَأَوْفُوا۟ بِٱلْعَهْدِ ۖ إِنَّ ٱلْعَهْدَ كَانَ مَسْـُٔولًۭا﴿٣٤ وَأَوْفُوا۟ ٱلْكَيْلَ إِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوا۟ بِٱلْقِسْطَاسِ ٱلْمُسْتَقِيمِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌۭ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًۭا﴿٣٥
(৩১) (৭) দারিদ্রের আশঙ্কায় নিজেদের সন্তান হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেবো এবং তোমাদেরকেও। আসলে তাদেরকে হত্যা করা একটি মহাপাপ।৩১ (৩২) (৮) যিনার কাছেও যেয়ো না, ওটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ।৩২ (৩৩) (৯) আল্লাহ‌ যাকে হত্যা করা হারাম করে দিয়েছেন,৩৩ সত্য ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না।৩৪ আর যে ব্যক্তি মজলুম অবস্থায় নিহত হয়েছে তার অভিভাবককে আমি কিসাস দাবী করার অধিকার দান করেছি।৩৫ কাজেই হত্যার ব্যাপারে তার সীমা অতিক্রম করা উচিত নয়, ৩৬ তাকে সাহায্য করা হবে।৩৭ (৩৪) (১০) ইয়াতীমের সম্পত্তির ধারে কাছে যেয়ো না, তবে হ্যাঁ সদুপায়ে, যে পর্যন্ত না সে বয়োপ্রাপ্ত হয়ে যায়।৩৮ (১১) প্রতিশ্রুতি পালন করো, অবশ্যই প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে তোমাদের জবাবদিহি করতে হবে। ৩৯ (৩৫) (১২) মেপে দেবার সময় পরিমাপ পাত্র ভরে দাও এবং ওজন করে দেবার সময় সঠিক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করো। ৪০ এটিই ভাল পদ্ধতি এবং পরিণামের দিক দিয়েও এটিই উত্তম।৪১
৩১) যেসব অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্তিতে প্রাচীনকাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত যুগে যুগে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন আন্দোলন দানা বেঁধেছে, এ আয়াতটি তার ভিত পুরোপুরি ধ্বসিয়ে দিয়েছে। প্রাচীন যুগে দারিদ্র্য ভীতি শিশু হত্যা ও গর্ভপাতের কারণ হতো। আর আজ তা দুনিয়াবাসীকে তৃতীয় আর একটি কৌশল অর্থাৎ গর্ভনিরোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু ইসলামের ঘোষণাপত্রের এ ধারাটি তাকে অন্নগ্রহণকারীদের সংখ্যা কমাবার ধ্বংসাত্মক প্রচেষ্টা ত্যাগ করে এমনসব গঠনমূলক কাজে নিজের শক্তি ও যোগ্যতা নিয়োগ করার র্নিদেশ দিচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর তৈরী প্রাকৃতিক বিধান অনুযায়ী রিযিক বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এ ধারাটির দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণের স্বল্পতার আশঙ্কায় মানুষের বারবার সন্তান উৎপাদনের সিলসিলা বন্ধ করে দিতে উদ্যত হওয়া তার বৃহত্তম ভুলগুলোর অন্যতম হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ ধারাটি মানুষকে এ বলে সাবধান করে দিচ্ছে যে, রিযিক পৌঁছাবার ব্যবস্থাপনা তোমার আয়ত্বাধীন নয় বরং এটি এমন এক আল্লাহর আয়ত্বাধীন যিনি তোমাকে এ যমীনে আবাদ করেছেন। পূর্বে আগমনকারীদেরকে তিনি যেভাবে রুজি দিয়ে এসেছেন তেমনিভাবে তোমাদেরকেও দেবেন। ইতিহাসের অভিজ্ঞতাও একথাই বলে, দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা যতই বৃদ্ধি হতে থেকেছে ঠিক সেই পরিমাণে বরং বহু সময় তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে অর্থনৈতিক উপায়-উপকরণ বেড়ে গিয়েছে। কাজেই আল্লাহর সৃষ্টি ব্যবস্থাপনায় মানুষের অযথা হস্তক্ষেপ নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এ শিক্ষার ফলেই কুরআন নাযিলের যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন যুগে মুসলমানদের মধ্যে জন্ম শাসনের কোন ব্যাপক ভাবধারা জন্ম লাভ করতে পারেনি।

৩২) “যিনার কাছেও যেয়ো না” এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও। ব্যক্তির জন্য এ হুকুমের মানে হচ্ছে, সে নিছক যিনার কাজ থেকে দূরে থেকেই ক্ষান্ত হবে না বরং এ পথের দিকে টেনে নিয়ে যায় যিনার এমন সব সূচনাকারী এবং প্রাথমিক উদ্যোগ ও আকর্ষণ সৃষ্টিকারী বিষয় থেকেও দূরে থাকবে। আর সমাজের ব্যাপারে বলা যায়, এ হুকুমের প্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে যিনা, যিনার উদ্যোগ-আকর্ষণ এবং তার কারণসমূহের পথ বন্ধ করে দেয়া সমাজের জন্য ফরয় হয়ে যাবে। এ উদ্দেশ্যে সে আইন প্রণয়ন, শিক্ষা ও অনুশীলন দান, সামাজিক পরিবেশের সংস্কার সাধন, সমাজ জীবনের যথাযোগ্য বিন্যাস এবং অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।

এ ধারাটি শেষ পর্যন্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থার একটি বৃহত্তম অধ্যায়ের বুনিয়াদে পরিণত হয়। এর অভিপ্রায় অনুযায়ী যিনা ও যিনার অপবাদকে ফৌজদারী অপরাধ গণ্য করা হয়। পর্দার বিধান জারী করা হয়। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার প্রচার কঠোরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়। মদ্যপান, নাচ, গান ও ছবির (যা যিনার নিকটতম আত্মীয়) ওপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। আর এ সঙ্গে এমন একটি দাম্পত্য আইন প্রণয়ন করা হয় যার ফলে বিবাহ সহজ হয়ে যায় এবং এ যিনার সামাজিক কারণসমূহের শিকড় কেটে যায়।

৩৩) “যাকে হত্যা” মানে কেবলমাত্রে অন্য ব্যক্তিকে হত্যা করাই নয়, নিজেকে হত্যা করাও এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ মানুষকে মহান আল্লাহ মর্যাদা সম্পন্ন করেছেন। অন্যের প্রাণের সাথে সাথে মানুষের নিজের প্রাণও এ সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত। কাজেই মানুষ হত্যা যত বড় গুনাহ ও অপরাধ, আত্মহত্যা করাও ঠিক তত বড় অপরাধ ও গুনাহ। মানুষ নিজেকে নিজের প্রাণের মালিক এবং এ মালিকানাকে নিজ ক্ষমতায় খতম করে দেবার অধিকার রাখে বলে মনে করে, এটা তার একটা বিরাট ভুল ধারণা। অথচ তার এ প্রাণ আল্লাহর মালিকানাধীন এবং সে একে খতম করে দেয়া তো দূরের কথা একে কোন অনুপযোগী কাজে ব্যবহার করার অধিকারও রাখে না। দুনিয়ার এ পরীক্ষাগৃহে আল্লাহ যেভাবেই আমাদের পরীক্ষা নেন না কেন, পরীক্ষার অবস্থা ভাল হোক বা মন্দ হোক, সেভাবেই শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষা দিতে থাকা উচিত। আল্লাহর দেয়া সময়কে ইচ্ছা করে খতম করে দিয়ে পরীক্ষাগৃহ থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করা একটি ভ্রান্ত পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার এ পালিয়ে যাবার কাজটিও এমন এক অপরাধের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যাকে আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় হারাম গণ্য করেছেন, এটা তো কোনক্রমেই গ্রহণীয় হতে পারে না। অন্য কথায় বলা যায়, দুনিয়ার ছোট ছোট কষ্ট, লাঞ্ছনা ও অপমানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মানুষ বৃহত্তর ও চিরন্তন কষ্ট ও লাঞ্ছনার দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
৩৪) পরবর্তীকালে ইসলামী আইন ‘সত্য সহকারে হত্যা’ কে শুধুমাত্র পাঁচটি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এক, জেনে বুঝে হত্যাকারী থেকে কিসাস নেয়া। দুই, আল্লাহর সত্যদ্বীনের পথে বাধাদানকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। তিন, ইসলামী রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করার প্রচেষ্টাকারীদের শাস্তি দেয়া, চার, বিবাহিত পুরুষ ও নারীকে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার শাস্তি দেয়া। পাঁচ, মুরতাদকে শাস্তি দেয়া। শুধুমাত্র এ পাঁচটি ক্ষেত্রে মানুষের প্রাণের মর্যাদা তিরোহিত হয় এবং তাকে হত্যা করা বৈধ গণ্য হয়।
৩৫) মূল শব্দ হচ্ছে, “তার অভিভাবককে আমি সুলতান দান করেছি।” এখানে সুলতান অর্থ হচ্ছে “প্রমাণ” যার ভিত্তিতে সে কিসাস দাবী করতে পারে। এ থেকে ইসলামী আ‌ইনের এ মূলনীতি বের হয় যে, হত্যা মোকদ্দমার আসল বাদী সরকার নয়। বরং নিহত ব্যক্তির অভিভাবকগণই এর মূল বাদীপক্ষ। তারা হত্যাকারীকে মাফ করে দিতে এবং কিসাসের পরিবর্তে রক্তপণ গ্রহণ করতে সম্মত হতে পারে।
৩৬) হত্যার ব্যাপারে বিভিন্নভাবে সীমা অতিক্রম করা যেতে পারে। এগুলো সবই নিষিদ্ধ। যেমন প্রতিশোধ গ্রহণ করতে গিয়ে উন্মত্তের মতো অপরাধী ছাড়া অন্যদেরকেও হত্যা করা। অথবা অপরাধীকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে মেরে ফেলা। কিংবা মেরে ফেলার পর তার লাশের ওপর মনের ঝাল মেটানো। অথবা রক্তপণ নেবার পর আবার তাকে হত্যা করা ইত্যাদি।
৩৭) যেহেতু সে সময় পর্যন্ত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাই কে তাকে সাহায্য করবে, একথা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। পরে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তখন ফায়সালা করে দেয়া হয় যে, তাকে সাহায্য করা তার গোত্র বা সহযোগী বন্ধু দলের কাজ নয় বরং এটা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র এবং তার বিচার ব্যবস্থার কাজ। কোন ব্যক্তি বা দল নিজস্বভাবে হত্যার প্রতিশোধ নেবার অধিকার রাখে না। বরং এটা ইসলামী সরকারের দায়িত্ব। ন্যায় বিচার লাভ করার জন্য তার কাছে সাহায্য চাওয়া হবে।
৩৮) এটিও নিছক একটি নৈতিক নির্দেশনামা ছিল না। বরং পরবর্তীকালে যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এতিমদের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য প্রশাসনিক ও আইনগত উভয় ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়। এর বিস্তারিত বিবরণ আমরা হাদীস ও ফিকাহর কিতাবগুলোতে পাই। তারপর এখান থেকে এ ব্যাপক ভিত্তিক মূলনীতি গ্রহণ করা হয় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের যেসব নাগরিক নিজেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণ করার ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে না রাষ্ট্রই তাদের স্বার্থের সংরক্ষক। নবী ﷺ বলেছেনঃ (আরবী------------------------------------------------) (যার কোন অভিভাবক নেই আমি তার অভিভাবক) এ হাদীসটি এদিকেই ইঙ্গিত করে এবং এ ইসলামী আইন একটি বিস্তৃত অধ্যায়ের ভূমিকা রচনা করে।
৩৯) এটিই নিছক ব্যক্তিগত নৈতিকতারই একটি ধারা ছিল না। বরং যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তখন একেই সমগ্র জাতির আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক রাজনীতির ভিত্তি প্রস্তর গণ্য করা হয়।
৪০) এ নির্দেশটাও নিছক ব্যক্তিবর্গের পারস্পরিক লেনদেন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয় বরং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হাট, বাজার ও দোকানগুলোতে মাপজোক ও দাঁড়িপাল্লাগুলো তত্বাবধান করা এবং শক্তি প্রয়োগ করে ওজনে ও মাপে কম দেয়া বন্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তারপর এখান থেকেই এ ব্যাপক মূলনীতি গৃহীত হয় যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে সব রকমের বেঈমানী ও অধিকার হরণের পথ রোধ করা সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
৪১) অর্থাৎ দুনিয়া ও আখেরাত উভয় স্থানেই। দুনিয়ায় এর শুভ পরিণামের কারণ হচ্ছে এই যে, এর ফলে পারস্পরিক আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা দু’জন দু’জনের ওপর ভরসা করে, এর ফলে ব্যবসায়ে উন্নতি আসে এবং ব্যাপক সমৃদ্ধি দেখা দেয়। অন্যদিকে আখেরাতে এর শুভ পরিণাম পুরোপুরি নির্ভর করে ঈমান ও আল্লাহ ভীতির ওপর।