আল বাকারাহ

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

বাকারাহ মানে গাভী। এ সূরার এক জায়গায় গাভীর উল্লেখ থাকার কারণে এর এই নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন মজীদের প্রত্যেকটি সূরায় এত ব্যাপক বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে, যার ফলে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে তাদের জন্য কোন পরিপূর্ণ ও সার্বিক অর্থবোধক শিরোনাম উদ্ভাবন করা সম্ভব নয়। শব্দ সম্ভারের দিক দিয়ে আরবী ভাষা অত্যন্ত সমৃদ্ধ হলেও মূলত এটি তো মানুষেরই ভাষা। আর মানুষের মধ্যে প্রচলিত ভাষাগুলো খুব বেশী সংকীর্ণ ও সীমিত পরিসর সম্পন্ন। সেখানে এই ধরনের ব্যাপক বিষয়বস্তুর জন্য পরিপূর্ণ অর্থব্যাঞ্জক শিরোনাম তৈরি করার মতো শব্দ বা বাক্যের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এজন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী কুরআনের অধিকাংশ সূরার জন্য শিরোনামের পরিবর্তে নিছক আলামত ভিত্তিক নাম রেখেছেন। এই সূরার নামকরণ আল বাকারাহ করার অর্থ কেবল এতটুকু যে, এখানে গাভীর কথা বলা হয়েছে।

নাযিলের সময়-কাল

এ সূরার বেশীর ভাগ মদীনায় হিজরতের পর মাদানী জীবনের একেবারে প্রথম যুগে নাযিল হয় । আর এর কম অংশ পরে নাযিল হয়। বিষয়স্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও সাদৃশ্যের কারণে এগুলোকে প্রথমোক্ত অংশের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। এমনকি সুদ নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত যে আয়াতগুলো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে নাযিল হয় সেগুলোও এখানে সংযোজিত করা হয়েছে। যে আয়াতগুলো দিয়ে সূরাটি শেষ করা হয়েছে সেগুলো হিজরতের আগে মক্কায় নাযিল হয়। কিন্তু বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যের কারণে সেগুলোকেও এ সূরার সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।

নাযিলের উপলক্ষ

এ সূরাটি বুঝতে হলে প্রথমে এর ঐতিহাসিক পটভূমি ভালোভাবে বুঝে নিতে হবে।

(১) হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াতের কাজ চলছিল কেবল মক্কায় । এ সময় পর্যন্ত সম্বোধন করা হচ্ছিল কেবলমাত্র আরবের মুশরিকদেরকে। তাদের কাছে ইসলামের বাণী ছিল সম্পূর্ণ নতুন ও অপরিচিত। এখন হিজরতের পরে ইহুদিরা সামনে এসে গেল। তাদের জনবসতিগুলো ছিল মদীনার সাথে একেবারে লাগানো। তারা তাওহীদ, রিসালাত, অহী, আখেরাত ও ফেরেশতার স্বীকৃতি দিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের নবী মূসা আলাইহিস সালামের ওপর যে শরিয়াতী বিধান নাযিল হয়েছিল তারও স্বীকৃতি দিত। নীতিগতভাবে তারাও সেই দ্বীন ইসলামের অনুসারী ছিল যার শিক্ষা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়ে চলছিলেন। কিন্তু বহু শতাব্দী কালের ক্রমাগত পতন ও অবনতির ফলে তারা আসল দ্বীন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ১ তাদের আকীদা-বিশ্বাসের মধ্যে বহু অনৈসলামী বিষয়ের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তাওরাতে এর কোন ভিত্তি ছিল না। তাদের কর্মজীবনে এমন অসংখ্য রীতি-পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছিল যথার্থ দ্বীনের সাথে যেগুলোর কোন সম্পর্ক ছিল না। তাওরাতের মূল বিষয়বস্তুর সাথেও এগুলোর কোন সামঞ্জস্য ছিল না। আল্লাহর কালাম তাওরাতের মধ্যে তারা মানুষের কথা মিশিয়ে দিয়েছিল। শাব্দিক বা অর্থগত দিক দিয়ে আল্লাহর কালাম যতটুকু পরিমাণ সংরক্ষিত ছিল তাকেও তারা নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকৃত করে দিয়েছিল। দ্বীনের যথার্থ প্রাণবস্তু তাদের মধ্য থেকে অন্তরহিত হয়ে গিয়েছিল । লোক দেখানো ধার্মিকতার নিছক একটা নিস্প্রাণ খোলসকে তারা বুকের সাথে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তাদের উলামা, মাশায়েখ, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ –-সবার আকীদা-বিশ্বাস এবং নৈতিক ও বাস্তব কর্মজীবন বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের এই বিকৃতির প্রতি তাদের আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যার ফলে কোনো প্রকার সংস্কার-সংশোধন গ্রহণের তারা বিরোধী হয়ে উঠেছিল। যখনই কোন আল্লাহর বান্দা তাদেরকে আল্লাহর দ্বীনের সরল-সোজা পথের সন্ধান দিতে আসতেন, তখনই তারা তাঁকে নিজেদের সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তার সংশোধন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগতো। শত শত বছর ধরে ক্রমাগতভাবে এই একই ধারার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলছিল। এরা ছিল আসলে বিকৃত মুসলিম। দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি, দ্বীন বহির্ভূত বিষয়গুলোর দ্বীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি, দলাদলি, বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বাদ দিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুত্বহীন বিষয় নিয়ে মাতামাতি, আল্লাহকে ভুলে যাওয়া ও পার্থিব লোভ-লালসায় আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে যাওয়ার কারণে তারা পতনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। এমন কি তারা নিজেদের আসল ‘মুসলিম’ নামও ভুলে গিয়েছিল। নিছক ‘ইহুদি’ নামের মধ্যেই তারা নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। আল্লাহর দ্বীনকে তারা কেবল ইসরাঈল বংশজাতদের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত উত্তরাধিকারে পরিণত করেছিল। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় পৌছার পর ইহুদিদেরকে আসল দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিলেন। সূরা বাকারার ১৫ ও ১৬ রুকূ’ এ দাওয়াত সম্বলিত। এ দু’রুকূ’তে যেভাবে ইহুদিদের ইতিহাস এবং তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার সমালোচনা করা হয়েছে এবং যেভাবে তাদের বিকৃত ধর্ম ও নৈতিকতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মোকাবিলায় যথার্থ দ্বীনের মূলনীতিগুলো পাশাপাশি উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আনুষ্ঠানিক ধার্মিকতার মোকাবিলায় যথার্থ ধার্মিকতা কাকে বলে, সত্য ধর্মের মূলনীতিগুলো কি এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে কোন্‌ কোন্‌ জিনিস যথার্থ গুরুত্বের অধিকারী তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

১. এ সময়ের প্রায় ১৯শ’বছর আগে হযরত মূসার (আ) যুগ অতীত হয়েছিল। ইসরাঈলী ইতিহাসের হিসেব মতে হযরত মূসা (আ) খৃঃ পূঃ ১২৭২ অব্দে ইন্তিকাল করেন। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৬১০ খৃস্টাব্দে নবুয়াত লাভ করেন।

(২) মদীনায় পৌছার পর ইসলামী দাওয়াত একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। মক্কায় তো কেবল দ্বীনের মূলনীতিগুলোর প্রচার এবং দ্বীনের দাওয়াত গ্রহণকারীদের নৈতিক প্রশিক্ষণ দানের মধ্যেই ইসলামী দাওয়াতের কাজ সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু হিজরতের পর যখন আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করে চতুর্দিক থেকে মদীনায় এসে জমায়েত হতে থাকলো এবং আনসারদের সহায়তায় একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্‌ গড়ে উঠলো, তখন মহান আল্লাহ সমাজ, সংস্কৃতি, লোকাচার, অর্থনীতি ও আইন সম্পর্কিত মৌলিক বিধান দিতে থাকলেন এবং ইসলামী মূলনীতির ভিত্তিতে এ নতুন জীবন ব্যবস্থাটি কিভাবে গড়ে তুলতে হবে তারও নির্দেশ দিতে থাকলেন। এ সূরার শেষ ২৩টি রুকু’তে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ নির্দেশ ও বিধানগুলো বয়ান করা হয়েছে। এর অধিকাংশ শুরুতেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং কিছু পাঠানো হয়েছিল পরবর্তী পর্যায়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিক্ষিপ্তভাবে।

(৩) হিজরতের পর ইসলাম ও কুফরের সংঘাতও একটি নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছিল। হিজরতের আগে ইসলামের দাওয়াত কুফরের ঘরের মধ্যেই দেয়া হচ্ছিল। তখন বিভিন্ন গোত্রের যেসব লোক ইসলাম গ্রহণ করতো, তারা নিজেদের জায়গায় দ্বীনের প্রচার করতো। এর জবাবে তাদের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। কিন্তু হিজরতের পরে এ বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা মদীনায় একত্র হয়ে একটি ছোট্ট ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার পর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে গেলো। তখন একদিকে ছিল একটি ছোট জনপদ এবং অন্যদিকে সমগ্র আরব ভূখন্ড তাকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। এখন এ ছোট্ট জামায়াতটির কেবল সাফল্যই নয় বরং তার অস্তিত্ব ও জীবনই নির্ভর করছিল পাঁচটি জিনিসের ওপর। এক, পূর্ণ শক্তিতে ও পরিপূর্ণ উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে নিজের মতবাদের প্রচার করে সর্বাধিক সংখ্যক লোককে নিজের চিন্তা ও আকীদা-বিশ্বাসের অনুসারী করার চেষ্টা করা। দুই, বিরোধীদের বাতিল ও ভ্রান্ত পথের অনুসারী বিষয়টি তাকে এমনভাবে প্রমাণ করতে হবে যেন কোন বুদ্ধি-বিবেকবান ব্যক্তির মনে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সংশয় না থাকে। তিন, গৃহহারা ও সারা দেশের মানুষের শত্রুতা ও বিরোধিতার সম্মুখীন হবার কারণে অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার এবং সার্বক্ষণিক অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতায় সে ভুগছিল। চতুর্দিক থেকে বিপদ তাকে ঘিরে নিয়েছিল। এ অবস্থায় যেন সে ভীত-সন্ত্রস্ত না হয়ে পড়ে। পূর্ণ ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা সহকারে যেন অবস্থার মোকাবিলা করে এবং নিজের সংকল্পের মধ্যে সামান্যতম দ্বিধা সৃষ্টির সুযোগ না দেয়। চার, তার দাওয়াতকে ব্যর্থকাম করার জন্য যে কোন দিক থেকে যে কোন সশস্ত্র আক্রমণ আসবে, পূর্ণ সাহসিকতার সাথে তার মোকাবিলা করার জন্য তাকে প্রস্তুত হতে হবে। বিরোধী পক্ষের সংখ্যা ও তাদের শক্তির আধিক্যের পরোয়া করা চলবে না। পাঁচ, তার মধ্যে এমন সুদৃঢ় হিম্মত সৃষ্টি করতে হবে, যার ফলে আরবের লোকেরা ইসলাম যে নতুন ব্যবস্থা কায়েম করতে চায় তাকে আপসে গ্রহণ করতে না চাইলে বল প্রয়োগে জাহেলিয়াতের বাতিল ব্যবস্থাকে মিটিয়ে দিতে সে একটুও ইতস্তত করবে না। এ সূরায় আল্লাহ এ পাঁচটি বিষয়ের প্রাথমিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

(৪) ইসলামী দাওয়াতের এ পর্যায়ে একটি নতুন গোষ্ঠীও আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছিল। এটি ছিল মুনাফিক গোষ্ঠী। নবী করীমের (সা.) মক্কায় অবস্থান কালের শেষের দিকেই মুনাফিকীর প্রাথমিক আলামতগুলো সুস্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল। তবুও সেখানে কেবল এমন ধরনের মুনাফিক পাওয়া যেতো যারা ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো এবং নিজেদের ঈমানের ঘোষণাও দিতো। কিন্তু এ সত্যের খাতিরে নিজেদের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে, নিজেদের পার্থিব সম্পর্কচ্ছেদ করতে এবং এ সত্য মতবাদটি গ্রহণ করার সাথে সাথেই যে সমস্ত বিপদ-আপদ, যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা ও নিপীড়ন–নির্যাতন নেমে আসতে থাকতো তা মাথা পেতে নিতে তারা প্রস্তুত ছিল না। মদীনায় আসার পর এ ধরনের মুনাফিকদের ছাড়াও আরো কয়েক ধরনের মুনাফিক ইসলামী দলে দেখা যেতে লাগলো। মুনাফিকদের এটি গোষ্ঠী ছিল ইসলামকে চূড়ান্তভাবে অস্বীকারকারী। তারা নিছক ফিত্‌না সৃষ্টি করার জন্য মুসলমানদের দলে প্রবেশ করতো।

মুনাফিকদের দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অবস্থা ছিল এই যে, চতুর্দিক থেকে মুসলিম কর্তৃত্ব ও প্রশাসন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে যাবার কারণে তারা নিজেদের স্বার্থ-সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে একদিকে নিজেদেরকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত করতো এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের সাথেও সম্পর্ক রাখতো। এভাবে তারা উভয় দিকের লাভের হিস্‌সা ঝুলিতে রাখতো এবং উভয় দিকের বিপদের ঝাপ্‌টা থেকেও সংরক্ষিত থাকতো।

তৃতীয় গোষ্ঠীতে এমন ধরনের মুনাফিকদের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ছিল ইসলাম ও জাহেলিয়াতের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে দোদুল্যমান। ইসলামের সত্যতার ব্যাপারে তারা পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল না। কিন্তু যেহেতু তাদের গোত্রের বা বংশের বেশির ভাগ লোক মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, তাই তারাও মুসলমান হয়ে গিয়েছিল।

মুনাফিকদের চতুর্থ গোষ্ঠীটিতে এমন সব লোকের সমাবেশ ঘটেছিল যারা ইসলামকে সত্য বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, কিন্তু জাহেলিয়াতের আচার–আচরণ, কুসংস্কার ও বিশ্বাসগুলো ত্যাগ করতে, নৈতিক বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খল গলায় পরে নিতে এবং দায়িত্ব ও কর্তব্যের বোঝা বহন করতে তাদের মন চাইতো না।

সূরা বাকারাহ নাযিলের সময় সবেমাত্র এসব বিভিন্ন ধরনের মুনাফিক গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ শুরু হয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ এখানে তাদের প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন মাত্র। পরবর্তীকালে তাদের চরিত্র ও গতি-প্রকৃতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকলো, ততই বিস্তারিতভাবে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন মুনাফিক গোষ্ঠীর প্রকৃতি অনুযায়ী পরবর্তী সূরাগুলোয় তাদের সম্পর্কে আলাদা আলাদাভাবে নির্দেশ দিয়েছেন।

وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِى عَنِّى فَإِنِّى قَرِيبٌ ۖ أُجِيبُ دَعْوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِ ۖ فَلْيَسْتَجِيبُوا۟ لِى وَلْيُؤْمِنُوا۟ بِى لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ﴿١٨٦ أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ ٱلصِّيَامِ ٱلرَّفَثُ إِلَىٰ نِسَآئِكُمْ ۚ هُنَّ لِبَاسٌۭ لَّكُمْ وَأَنتُمْ لِبَاسٌۭ لَّهُنَّ ۗ عَلِمَ ٱللَّهُ أَنَّكُمْ كُنتُمْ تَخْتَانُونَ أَنفُسَكُمْ فَتَابَ عَلَيْكُمْ وَعَفَا عَنكُمْ ۖ فَٱلْـَٔـٰنَ بَـٰشِرُوهُنَّ وَٱبْتَغُوا۟ مَا كَتَبَ ٱللَّهُ لَكُمْ ۚ وَكُلُوا۟ وَٱشْرَبُوا۟ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلْخَيْطُ ٱلْأَبْيَضُ مِنَ ٱلْخَيْطِ ٱلْأَسْوَدِ مِنَ ٱلْفَجْرِ ۖ ثُمَّ أَتِمُّوا۟ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيْلِ ۚ وَلَا تُبَـٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَـٰكِفُونَ فِى ٱلْمَسَـٰجِدِ ۗ تِلْكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَـٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ﴿١٨٧ وَلَا تَأْكُلُوٓا۟ أَمْوَٰلَكُم بَيْنَكُم بِٱلْبَـٰطِلِ وَتُدْلُوا۟ بِهَآ إِلَى ٱلْحُكَّامِ لِتَأْكُلُوا۟ فَرِيقًۭا مِّنْ أَمْوَٰلِ ٱلنَّاسِ بِٱلْإِثْمِ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴿١٨٨ ۞ يَسْـَٔلُونَكَ عَنِ ٱلْأَهِلَّةِ ۖ قُلْ هِىَ مَوَٰقِيتُ لِلنَّاسِ وَٱلْحَجِّ ۗ وَلَيْسَ ٱلْبِرُّ بِأَن تَأْتُوا۟ ٱلْبُيُوتَ مِن ظُهُورِهَا وَلَـٰكِنَّ ٱلْبِرَّ مَنِ ٱتَّقَىٰ ۗ وَأْتُوا۟ ٱلْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَٰبِهَا ۚ وَٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴿١٨٩ وَقَـٰتِلُوا۟ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يُقَـٰتِلُونَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوٓا۟ ۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلْمُعْتَدِينَ﴿١٩٠
(১৮৬) আর হে নবী! আমার বান্দা যদি তোমার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে তাদেরকে বলে দাও, আমি তাদের কাছেই আছি। যে আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি এবং জবাব দেই, কাজেই তাদের আমার আহবানে সাড়া দেয়া এবং আমার ওপর ঈমান আনা উচিত১৮৮ একথা তুমি তাদের শুনিয়ে দাও, হয়তো সত্য-সরল পথের সন্ধান পাবে। ১৮৯ (১৮৭) রোযার সময় রাতের বেলা স্ত্রীদের কাছে যাওয়া তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।১৯০ আল্লাহ জানতে পেরেছেন, তোমরা চুপি চুপি নিজেরাই নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলে। কিন্তু তিনি তোমাদের অপরাধ মাফ করে দিয়েছেন এবং তোমাদের ক্ষমা করেছেন। এখন তোমরা নিজেদের স্ত্রীদের সাথে রাত্রিবাস করো এবং যে স্বাদ আল্লাহ‌ তোমাদের জন্য বৈধ করে দিয়েছেন তা গ্রহণ করো।১৯১ আর পানাহার করতে থাকো।১৯২ যতক্ষণ না রাত্রির কালো রেখার বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।১৯৩ তখন এসব কাজ ত্যাগ করে রাত পর্যন্ত নিজের রোযা পূর্ণ করো।১৯৪ আর যখন তোমরা মসজিদে ই’তিকাফে বসো তখন স্ত্রীদের সাথে সহবাস করো না।১৯৫ এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা, এর ধারে কাছেও যেয়ো না।১৯৬ এভাবে আল্লাহ‌ তাঁর বিধান লোকদের জন্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন, আশা করা যায় এর ফলে তারা ভুল কর্মনীতি গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। (১৮৮) আর তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের সম্পদ অবৈধ পদ্ধতিতে খেয়ো না এবং শাসকদের সামনেও এগুলোকে এমন কোন উদ্দেশ্যে পেশ করো না যার ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে তোমরা অন্যের সম্পদের কিছু অংশ খাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাও।১৯৭ (১৮৯) লোকেরা তোমাকে চাঁদ ছোট বড়ো হওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে। বলে দাওঃ এটা হচ্ছে লোকদের জন্য তারিখ নির্ণয় ও হজ্জ্বের আলামত১৯৮ তাদেরকে আরো বলে দাওঃ তোমাদের পেছন দিক দিয়ে গৃহে প্রবেশ করার মধ্যে কোন নেকী নেই। আসলে নেকী রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে বাঁচার মধ্যেই, কাজেই তোমরা দরজা পথেই নিজেদের গৃহে প্রবেশ করো। তবে আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, হয়তো তোমরা সাফল্য লাভে সক্ষম হবে।১৯৯ (১৯০) আর তোমরা আল্লাহর পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে,২০০ কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না। কারণ যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ‌ তাদের পছন্দ করেন না।২০১
১৮৮) অর্থাৎ যদিও তোমরা আমাকে দেখতে পাও না এবং ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভবও করতে পারো না তবুও আমাকে তোমাদের থেকে দূরে মনে করো না। আমি আমার প্রত্যেক বান্দার অতি নিকটেই অবস্থান করছি। যখনই তারা চায় আমার কাছে আর্জি পেশ করতে পারে। এমনকি মনে মনে আমার কাছে তারা যা কিছু আবেদন করে তাও আমি শুনতে পাই। আর কেবল শুনতেই পাই না বরং সে সম্পর্কে নিজের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করি। নিজেদের অজ্ঞতা ও মূর্খতার কারণে যে সমস্ত অলীক, কাল্পনিক ও অক্ষম সত্ত্বাদেরকে তোমরা উপাস্য ও প্রভু গণ্য করেছো তাদের কাছে তোমাদের নিজেদের দৌঁড়িয়ে যেতে হয় এবং তারপরও তারা তোমাদের কোন আবেদন নিবেদন শুনতে পায় না। তোমাদের আবেদনের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাও তাদের নেই। অন্যদিকে আমি হচ্ছি এই বিশাল বিস্তৃত বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি। সমস্ত সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব আমারই হাতে কেন্দ্রীভূত। তোমাদের এতো কাছে আমি অবস্থান করি যে, কোন প্রকার মাধ্যম ও সুপারিশ ছাড়াই তোমরা নিজেরাই সরাসরি সর্বত্র ও সবসময় আমার কাছে নিজেদের আবেদন নিবেদন পেশ করতে পারো। কাজেই একের পর এক অক্ষম ও বানোয়াট খোদার দ্বারে দ্বারে মাথা ঠুকে মরার অজ্ঞতা ও মূর্খতার বেড়াজাল তোমরা ছিঁড়ে ফেলো। আমি তোমাদের যে আহবান জানাচ্ছি সে আহবানে সাড়া দাও। আমার আদর্শকে আঁকড়ে ধরো। আমার দিকে ফিরে এসো। আমার ওপর নির্ভর করো। আমার বন্দেগী ও আনুগত্য করো।
১৮৯ ) অর্থাৎ তোমার মাধ্যমে এই ধ্রুব সত্য জানার পর তাদের চোখ খুলে যাবে। তারা সঠিক ও নির্ভুল কর্মনীতি অবলম্বন করবে, যার মধ্যে তাদের নিজেদের কল্যাণ নিহিত।
১৯০) অর্থাৎ পোশাক ও শরীরের মাঝখানে যেমন কোন পর্দা বা আবরণ থাকতে পারে না এবং উভয়ের সম্পর্ক ও সম্মিলন হয় অবিচ্ছিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য, ঠিক তেমনি তোমাদের ও তোমাদের স্ত্রীদের সম্পর্কও।
১৯১) শুরুতে রমযান মাসের রাত্রিকালে স্ত্রীর সাথে রাত্রিবাস করার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ না থাকলেও লোকেরা এমনটি করা অবৈধ মনে করতো। তারপর এই অবৈধ বা অপছন্দনীয় হবার ধারণা মনে মনে পোষণ করে অনেক সময় তারা নিজেদের স্ত্রীদের কাছে চলে যেতো। এটা যেন নিজের বিবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হতো। এর ফলে তাদের মধ্যে একটি অপরাধ ও পাপ মনোবৃত্তির লালনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তাই মহান আল্লাহ‌ প্রথমে তাদেরকে বিবেকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন অতঃপর বলেছেন, এটি তোমাদের জন্য বৈধ। কাজেই এখন তোমরা খারাপ কাজ মনে করে একে করো না বরং আল্লাহ‌ প্রদত্ত অনুমতির সুযোগ গ্রহণ করে মন ও বিবেকের পূর্ণ পবিত্রতা সহকারে করো।
১৯২) এ ব্যাপারেও শুরুতে লোকদের ভুল ধারণা ছিল। কারোর ধারণা ছিল, এশার নামায পড়ার পর থেকে পানাহার হারাম হয়ে যায়। আবার কেউ মনে করতো, রাতে যতক্ষণ জেগে থাকা হয় ততক্ষণ পানাহার করা যেতে পারে, ঘুমিয়ে পড়ার পর আবার উঠে কিছু খাওয়া যেতে পারে না। লোকেরা মনে মনে এই বিধান কল্পনা করে রেখেছিল এর ফলে অনেক সময় তাদের বড়ই ভোগান্তি হতো। এই আয়াতে ঐ ভুল ধারণাগুলো দূর করা হয়েছে। এখানে রোযার সীমানা বর্ণনা করা হয়েছে প্রভাতের শ্বেত আভার উদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত। অন্যদিকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পর থেকে নিয়ে প্রভাতের সাদা রেখা জেগে না ওঠা পর্যন্ত সারা রাত পানাহার ও স্ত্রী সম্ভোগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এই সাথে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেহরী খাওয়ার নিয়মের প্রচলন করেছেন, যাতে প্রভাতের উদয়ের ঠিক পূর্বেই লোকেরা ভালোভাবে পানাহার করে নিতে পারে।
১৯৩) ইসলাম তার ইবাদাত-বন্দেগীর জন্য সময়ের এমন একটি মান নির্ণয় করে দিয়েছে যার ফলে দুনিয়ায় সর্বকালে সকল তামাদ্দুনিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে লালিত লোকেরা সব দেশে ও সব জায়গায় ইবাদাতের সময় নির্ধারণ করে নিতে সক্ষম হয়। ঘড়ির সাহায্যে সময় নির্ধারণ করার পরিবর্তে আকাশে ও দিগন্তে উদ্ভাসিত সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহের প্রেক্ষিতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞ ও আনাড়ী লোকেরা এই সময় নির্ধারণ পদ্ধতির বিরুদ্ধে সাধারণত এই মর্মে আপত্তি উত্থাপন করেছে যে, উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুর সন্নিকটে, যেখানে রাত ও দিন হয় কয়েক মাসের, সেখানে এই সময় নির্ধারণ পদ্ধতি কিভাবে কাজে লাগবে? অথচ অগভীর ভূগোল জ্ঞানের কারণে তাদের মনে এ প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আসলে আমরা বিষুব রেখার আশেপাশের এলাকার লোকেরা যে অর্থে দিন ও রাত শব্দ দু’টি বলে থাকি উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু এলাকায় ঠিক সেই অর্থে ছ’মাস রাত ও ছ’মাস দিন হয় না। রাত্রির পালা বা দিনের পালা যাই হোক না কেন, মোট কথা সকাল ও সন্ধ্যার আলামত সেখানে যথারীতি দিগন্তে ফুটে ওঠে এবং তারই প্রেক্ষিতে সেখানকার লোকেরা আমাদেরই মতো নিজেদের ঘুমোবার, জাগবার, কাজকর্ম করার ও বেড়াবার আয়োজন করে থাকে। যে যুগে ঘড়ির ব্যাপক প্রচলন ছিলনা সে যুগেও ফিনল্যাণ্ড, নরওয়ে, গ্রীনল্যাণ্ড ইত্যাদির দেশের লোকেরা নিজেদের সময় অবশ্যি জেনে নিতো। সে আমলে তাদের সময় জানার উপায় ছিল এই দিগন্তের আলামত। কাজেই দুনিয়ার আর সব ব্যাপারে এই আলামতগুলো যেমন তাদের সময় নির্ধারণে সাহায্য করতো তেমনিভাবে নামায, রোযা, সেহরী ও ইফতারের ব্যাপারেও তাদের সময় নির্ধারণ করতে সক্ষম।
১৯৪) রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ করার অর্থ হচ্ছে, যেখানে রাতের সীমানা শুরু হচ্ছে সেখানে তোমাদের রোযার সীমানা শেষ হয়ে যাচ্ছে। সবাই জানেন, রাতের সীমানা শুরু হয় সূর্যাস্ত থেকে। কাজেই সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ইফতার করা উচিত। সেহরী ও ইফতারের সঠিক আলামত হচ্ছে, রাতের শেষ ভাগে যখন পূর্ব দিগন্তে প্রভাতের শুভ্রতার সরু রেখা ভেসে উঠে ওপরের দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন সেহরীর সময় শেষ হয়ে যায়। আবার যখন দিনের শেষ ভাগে পূর্ব দিগন্ত থেকে রাতের আঁধার ওপরের দিকে উঠতে থাকে তখন ইফতারের সময় হয়। আজকাল লোকেরা সেহরী ও ইফতার উভয় ব্যাপারে অত্যধিক সতর্কতার কারণে কিছু অযথা কড়াকড়ি শুরু করেছে। কিন্তু শরীয়াত ঐ দু’টি সময়ের এমন কোন সীমানা নির্ধারণ করে দেয়নি যে তা থেকে কয়েক সেকেণ্ড বা কয়েক মিনিট এদিক ওদিক হয়ে গেলে রোযা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। প্রভাত কালে রাত্রির কালো বুক চিরে প্রভাতের সাদা রেখা ফুটে ওঠার মধ্যে যথেষ্ট সময়ের অবকাশ রয়েছে। ঠিক প্রভাতের উদয় মুহূর্তে যদি কোন ব্যক্তির ঘুম ভেঙে যায় তাহলে সঙ্গতভাবেই সে তাড়াতাড়ি উঠে কিছু পানাহার করে নিতে পারে। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যদি তোমাদের কেউ সেহরী খাচ্ছে এমন সময় আযানের আওয়াজ কানে এসে গিয়ে থাকে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই সে যেন আহার ছেড়ে না দেয় বরং পেট ভরে পানাহার করে নেয়। অনুরূপভাবে ইফতারের সময়ও সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অযথা দিনের আলো মিলিয়ে যাওয়ার প্রতীক্ষায় বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। নবী ﷺ সূর্য ডোবার সাথে সাথেই বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে ডেকে বলতেন, আমার শরবত আনো। বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন, হে আল্লাহর রসূল! এখনো তো দিনের আলো ফুটে আছে। তিনি জবাব দিতেন, যখন রাতের আঁধার পূর্বাকাশ থেকে উঠতে শুরু করে তখনই রোযার সময় শেষ হয়ে যায়।
১৯৫) ইতিকাফে বসার মানে হচ্ছে, রমযানের শেষ দশ দিন মসজিদে অবস্থান করা এবং এই দিনগুলোকে আল্লাহর যিকিরের জন্য নির্দিষ্ট করা। এই ইতিকাফে থাকা অবস্থায় নিজের মানবিক ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যায় কিন্তু যৌন স্বাদ আস্বাদন করা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ দূরে রাখা একান্ত অপরিহার্য।
১৯৬) এই সীমারেখাগুলো অতিক্রম করার কথা বলা হয়নি বরং বলা হয়েছে, এগুলোর ধারে কাছেও যেয়ো না। এর অর্থ হচ্ছে, যেখান থেকে গোনাহের সীমানা শুরু হচ্ছে ঠিক সেই শেষ প্রান্তে সীমানা লাইন বরাবর ঘোরাফেরা করা বিপদজ্জনক। সীমান্ত থেকে দূরে থাকাই নিরাপদ ব্যবস্থা। কারণ সীমান্ত বরাবর ঘোরাফেরা করলে ভুলেও কখনো সীমান্তের ওপারে পা চলে যেতে পারে। তাই এ ব্যাপারে নবী ﷺ বলেছেনঃ

لِكُلِّ مَلِكٍ حِمًى وَإِنَّ حِمَى اللَّهِ مَحَارِمُهُ فَمَن رتَعَ حَوْلَ الْحِمَى يُوشِكُ أَنْ يَّقِعَ فِيهِ

“প্রত্যেক বাদশাহর একটি ‘হিমা’ থাকে। আর আল্লাহর হিমা হচ্ছে তাঁর নির্ধারিত হারাম বিষয়গুলো। কাজেই যে ব্যক্তি হিমার চারদিকে ঘুরে বেড়ায় তার হিমার মধ্যে পড়ে যাবার আশঙ্কাও রয়েছে।”

আরবী ভাষায় “হিমা” বলা হয় এমন একটি চারণক্ষেত্রকে যাকে কোন নেতা বা বাদশাহ সাধারণ মানুষের মধ্যে নিষিদ্ধ করে দেন। এই উপমাটি ব্যবহার করে নবী ﷺ বলছেন, প্রত্যেক বাদশাহর একটি হিমা আছে আর আল্লাহর হিমা হচ্ছে তাঁর সেই সীমানাগুলো যার মাধ্যমে তিনি হালাল ও হারাম এবং আনুগত্য ও অবাধ্যতার পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। যে পশু ‘হিমার’ (বেড়া) চারপাশে চরতে থাকে একদিন সে হয়তো হিমার মধ্যেও ঢুকে পড়তে পারে। দুঃখের বিষয় শরীয়াতের মৌল প্রাণসত্ত্বা সম্পর্কে অনবহিত লোকেরা সবসময় অনুমতির শেষ সীমায় চলে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে থাকে। আবার অনেক আলেম ও মাশায়েখ এই বিপজ্জনক সীমানায় তাদের ঘোরাফেরা করতে দেয়ার উদ্দেশ্যে দলীল প্রমাণ সংগ্রহ করে অনুমতির শেষ সীমা তাদেরকে জানিয়ে দেয়ার কাজ করে যেতে থাকে। অথচ অনুমতির এই শেষ সীমায় আনুগত্য ও অবাধ্যতার মধ্যে মাত্র চুল পরিমাণ ব্যবধান থেকে যায়। এরই ফলে আজ অসংখ্য লোক গোনাহ এবং তার থেকে অগ্রসর হয়ে গোমরাহীতে লিপ্ত হয়ে চলেছে। কারণ ঐ সমস্ত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সীমান্ত রেখার মধ্যে পার্থক্য করা এবং তাদের কিনারে পৌঁছে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ কথা নয়।

১৯৭) এই আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, শাসকদেরকে উৎকোচ দিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হবার চেষ্টা করো না। এর দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমরা নিজেরাই যখন জানো এগুলো অন্যের সম্পদ তখন শুধুমাত্র তার কাছে তার সম্পদের মালিকানার কোন প্রমাণ না থাকার কারণে অথবা একটু এদিক সেদিক করে কোন প্রকারে প্যাঁচে ফেলে তার সম্পদ তোমরা গ্রাস করতে পারো বলে তার মামলা আদালতে নিয়ে যেয়ো না। মামলার ধারা বিবরণী শোনার পর হয়তো তারই ভিত্তিতে আদালত তোমাকে ঐ সম্পদ দান করতে পারে। কিন্তু বিচারকের এ ধরনের ফায়সালা হবে আসলে সাজানো মামলার নকল দলিলপত্র দ্বারা প্রতারিত হবার ফলশ্রুতি। তাই আদালত থেকে ঐ সম্পদ বা সম্পত্তির বৈধ মালিকানা অধিকার লাভ করার পরও প্রকৃতপক্ষে তুমি তার বৈধ মালিক হতে পারবে না। আল্লাহর কাছে তা তোমার জন্য হারামই থাকবে। হাদীসে বিবৃত হয়েছে, নবী ﷺ বলেছেনঃ

انما انا بشر وانتم تختصمون الى ولعل بعضكم يكون الحن بحجته من بعض فاقضى له على نحو ما اسمع منه- فمن قضيت له بشئ من حق اخيه فانما اقضى له قطعة من النار

“আমি তো একজন মানুষ। হতে পারে, তোমরা একটি মামলা আমার কাছে আনলে। এক্ষেত্রে দেখা গেলো তোমাদের এক পক্ষ অন্য পক্ষের তুলনায় বেশী বাকপটু এবং তাদের যুক্তি-আলোচনা শুনে আমি তাদের পক্ষে রায় দিতে পারি। কিন্তু জেনে রাখো, তোমার ভাইয়ের অধিকারভুক্ত কোন জিনিস যদি তুমি এভাবে আমার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লাভ করো, তাহলে, আসলে তুমি দোজখের একটি টুকরা লাভ করলে।”

১৯৮) চাঁদের হ্রাস বৃদ্ধি হওয়ার দৃশ্যটি প্রতি যুগের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। অতীতে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতির মধ্যে এ সম্পর্কে নানা ধরনের রহস্যময়তা, কাল্পনিকতা ও কুসংস্কারের প্রচলন ছিল এবং আজও রয়েছে। আরবের লোকদের মধ্যেও এ ধরনের কুসংস্কার ও অমূলক ধারণা-কল্পনার প্রচলন ছিল। চাঁদ থেকে ভালো মন্দ ‘লক্ষণ’ গ্রহণ করা হতো। কোন তারিখকে সৌভাগ্যের ও কোন তারিখকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক মনে করা হতো। কোন তারিখকে বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাত্রার জন্য, কোন তারিখকে কাজ শুরু করার জন্য এবং কোন তারিখকে বিয়ে-সাদীর জন্য অপয়া বা অকল্যাণকর মনে করা হতো। আবার একথাও মনে করা হতো যে, চাঁদের উদয়াস্ত, হ্রাস-বৃদ্ধি ও আবর্তণ এবং চন্দ্রগ্রহণের প্রভাব মানুষের ভাগ্যের ওপর পড়ে। দুনিয়ার অন্যান্য অজ্ঞ ও মূর্খ জাতিদের মতো আরবদের মধ্যেও এ সমস্ত ধারণা-কল্পনার প্রচলন ছিল। এ সম্পর্কিত নানা ধরনের কুসংস্কার, রীতিনীতি ও অনুষ্ঠানাদি তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসব বিষয়ের সত্যতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। জবাবে মহান আল্লাহ‌ বলেন, চাঁদের হ্রাস-বৃদ্ধি হওয়ার তাৎপর্য এছাড়া আর কিছুই নয় যে, এটা একটা প্রাকৃতিক ক্যালেণ্ডার যা আকাশের গায়ে টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন আকাশ কিনারে উঁকি দিয়ে এ ক্যালেণ্ডারটি একই সাথে সারা দুনিয়ার মানুষকে তারিখের হিসেব জানিয়ে দিতে থাকে। এখানে হজ্জের উল্লেখ বিশেষ করে করার কারণ হচ্ছে এই যে, আরবের ধর্মীয় তামাদ্দুনিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এর গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। বছরের এক-তৃতীয়াংশ সময় অর্থাৎ চারটি মাসই ছিল হজ্জ ও উমরাহর সাথে সম্পর্কিত। এ মাসগুলোয় যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ থাকতো, পথঘাট সংরক্ষিত ও নিরাপদ থাকতো এবং শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ বজায় থাকার কারণে ব্যবসা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটতো।
১৯৯) আরবে যে সমস্ত কুসংস্কারমূলক প্রথার প্রচলন ছিল তার মধ্যে একটি ছিল হজ্জ সম্পর্কিত। কোন ব্যক্তি হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধার পর নিজের গৃহের দরজা দিয়ে আর ভেতরে প্রবেশ করতো না। বরং গৃহে প্রবেশ করার জন্য পেছন থেকে দেয়াল টপকাতো বা দেয়াল কেটে জানালা বানিয়ে তার মধ্য দিয়ে গৃহে প্রবেশ করতো। তাছাড়া সফর থেকে ফিরে এসেও পেছন থেকে গৃহে প্রবেশ করতো। এই আয়াতে কেবলমাত্র এই প্রথাটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদই জানানো হয়নি বরং এই বলে সকল প্রকার কুসংস্কার ও কুপ্রথার মূলে আঘাত হানা হয়েছে যে, নেকী ও সৎকর্মশীলতা হচ্ছে আসলে আল্লাহকে ভয় করা এবং তাঁর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করা থেকে বিরত থাকার নাম। নিছক বাপ-দাদার অন্ধ অনুসরণের বশবর্তী হয়ে যেসব অর্থহীন নিয়ম প্রথা পালন করা হচ্ছে এবং যেগুলোর সাথে মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের কোন সম্পর্কই নেই, সেগুলো আসলে নেকী ও সৎকর্ম নয়।
২০০) আল্লাহর কাজে যারা তোমাদের পথরোধ করে দাঁড়ায় এবং আল্লাহ‌ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী তোমরা জীবন ব্যবস্থার সংস্কার ও সংশোধন করতে চাও বলে যারা তোমাদের শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তোমাদের সংশোধন ও সংস্কার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য জুলুম-অত্যাচার চালাচ্ছে ও শক্তি প্রয়োগ করছে, তাদের সাথে যুদ্ধ করো। এর আগে মুসলমানরা যতদিন দুর্বল ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ছিল, তাদেরকে কেবলমাত্র ইসলাম প্রচারের হুকুম দেয়া হয়েছিল এবং বিপক্ষের জুলুম-নির্যাতনে সবর করার তাগিদ করা হচ্ছিল। এখন মদীনায় তাদের একটি ছোট্ট স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর এই প্রথমবার তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, যারাই এই সংস্কারমূলক দাওয়াতের পথে সশস্ত্র প্রতিরোধ সৃষ্টি করছে অস্ত্র দিয়েই তাদের অস্ত্রের জবাব দাও। এরপরই অনুষ্ঠিত হয় বদরের যুদ্ধ। তারপর একের পর এক যুদ্ধ অনু্ষ্ঠিত হতেই থাকে।
২০১) অর্থাৎ বস্তুগত স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে তোমরা যুদ্ধ করবে না। আল্লাহ‌ প্রদত্ত সত্য সঠিক জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে যারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না তাদের ওপর তোমরা হস্তক্ষেপ করবে না। যুদ্ধের ব্যাপারে জাহেলী যুগের পদ্ধতি অবলম্বন করবে না। নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও আহতদের গায়ে হাত ওঠানো, শত্রু পক্ষের নিহতদের লাশের চেহারা বিকৃত করা, শস্যক্ষেত ও গবাদি পশু অযথা ধ্বংস করা এবং অন্যান্য যাবতীয় জুলুম ও বর্বরতামূলক কর্মকাণ্ড “বাড়াবাড়ি” এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসবগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। আয়াতের মূল বক্তব্য হচ্ছে এই যে, একমাত্র অপরিহার্য ক্ষেত্রেই শক্তির ব্যবহার করতে হবে এবং ঠিক ততটুকু পরিমাণ ব্যবহার করতে হবে যতটুকু সেখানে প্রয়োজন।