আন্ নিসা

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নাযিল হওয়ার সময়-কাল ও বিষয়বস্তু

এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাযিল হয়। যদিও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না, কোন আয়াত থেকে কোন আয়াত পর্যন্ত একটি ভাষণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নাযিল হয়েছিল এবং তার নাযিলের সময়টা কি ছিল, তবুও কোন কোন বিধান ও ঘটনার দিকে কোথাও কোথাও এমন সব ইঙ্গিত করা হয়েছে যার সহায়তায় রেওয়ায়াত থেকে আমরা তাদের নাযিলের তারিখ জানতে পারি। তাই এগুলোর সাহায্যে আমরা এসব বিধান ও ইঙ্গিত সম্বলিত এ ভাষণগুলোর মোটামুটি একটা সীমা নির্দেশ করতে পারি।

যেমন আমরা জানি উত্তরাধিকার বন্টন ও এতিমদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের মীরাস কিভাবে বন্টন করা হবে এবং তারা যেসব এতিম ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরই ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথম চারটি রুকু, ও পঞ্চম রুকূর প্রথম তিনটি আয়াত এ সময় নাযিল হয়ে থাকবে।

যাতুর রিকা’র যুদ্ধে ভয়ের নামায (যুদ্ধ চলা অবস্থায় নামায পড়া) পড়ার রেওয়ায়াত আমরা হাদীসে পাই। এ যুদ্ধটি চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাই এখানে অনুমান করা যেতে পারে, যে ভাষণে (১৫ রুকূ’) এ নামাযের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি এরই কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে।

চতুর্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মদীনা থেকে বনী নযীরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই যে ভাষণটিতে ইহুদীদেরকে এ মর্মে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি তোমাদের চেহারা বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবার আগে ঈমান আনো, সেটি এর পূর্বে কোন নিকটতম সময়ে নাযিল হয়েছিল বলে শক্তিশালী অনুমান করা যেতে পারে।

বনীল মুসতালিকের যুদ্ধের সময় পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এ যুদ্ধটি পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যে ভাষণটিতে (৭ম রুকূ’) তায়াম্মুমের কথা উল্লেখিত হয়েছিল সেটি এ সময়ই নাযিল হয়েছিল মনে করতে হবে।

নাযিল হওয়ার কারণ ও আলোচ্য বিষয়

এভাবে সামগ্রিক পর্যায়ে সূরাটি নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানার পর আমাদের সেই যুগের ইতিহাসের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়া উচিত। এর সাহায্যে সূরাটি আলোচ্য বিষয় অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল সেগুলোকে তিনটি বড় বড় বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। এক, একটি নতুন ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। হিজরতের পরপরই মদীনা তাইয়েবা ও তার আশেপাশের এলাকায় এ সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতি নির্মূল করে নৈতিকতা, তামাদ্দুন, সমাজরীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নতুন নীতি-নিয়ম প্রচলনের কর্মতৎপরতা এগিয়ে চলছিল। দুই, আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদী গোত্রসমূহ ও মুনাফিকদের সংস্কার বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারী রাখা। তিন, এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকা এবং এ জন্য আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেখানে ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা। এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যতগুলো ভাষণ অবতীর্ণ হয়, তা সবই এই তিনটি বিভাগের সাথে সম্পর্কিত।

ইসলামের সামাজিক কাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবে এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম অবস্থায় যে সমস্ত নির্দেশ ও বিধানের প্রয়োজন ছিল সূরা বাকারায় সেগুলো প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সমাজ আগের চাইতে বেশী সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই এখানে আরো নতুন নতুন বিধান ও নির্দেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য সূরা নিসার এ ভাষণগুলোতে মুসলমানরা কিভাবে ইসলামী পদ্ধতিতে তাদের সামাজিক জীবনধারার সংশোধন ও সংস্কার সাধন করতে পারে তা আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে পরিবার গঠনের নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। বিয়েকে বিধি-নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। এতিমদের অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মীরাস বন্টনের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়েছে। অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরোয়া বিবাদ মিটাবার পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। অপরাধ দণ্ডবিধির ভিত গড়ে তোলা হয়েছে। মদপানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের বিধান দেয়া হয়েছে। আল্লাহ ও বান্দার সাথে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের কর্মধারা কেমন হতে পারে, তা মুসলমানদের জানানো হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দলীল সংগঠন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। আহলি কিতাবদের নৈতিক, ধর্মীয় মনোভাব ও কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পূর্ববর্তী উম্মতদের পদাংক অনুসরণ করে চলা থেকে বিরত থাকে। মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা করে যথার্থ ও খাঁটি ঈমানদারীর এবং ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য সূচক চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছে।

ইসলাম বিরোধী শক্তিদের সাথে যে সংঘাত চলছিল ওহোদ যুদ্ধের পর তা আরো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল। ওহোদের পরাজয় আশপাশের মুশরিক গোত্রসমূহ, ইহুদী প্রতিবেশীবৃন্দ ও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা মুনাফিকদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলমানরা সবদিক থেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করলেন এবং অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় কাজ করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। মদীনায় মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকেরা সব ধরনের ভীতি ও আশংকার খবর ছড়িয়ে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। এ ধরনের প্রত্যেকটি খবর দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার এবং কোন খবর সম্পর্কে পুরোপুরি অনুসন্ধান না করার আগে তা প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার নির্দেশ দেয়া হয়।

মুসলমানদের বারবার যুদ্ধে ও নৈশ অভিযানে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হতো যেখানে পানির চিহ্নমাত্রও পাওয়া যেতো না। সে ক্ষেত্রে পানি না পাওয়া গেলে ওযু ও গোসল দুয়ের জন্য তাদের তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়াও এ অবস্থায় সেখানে নামায সংক্ষেপে করারও অনুমতি দেয়া হয়। আর যেখানে বিপদ মাথার ওপর চেপে থাকে সেখানে সালাতুল খওফ (ভয়কালীন নামায) পড়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়। আরবের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুসলমান কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং অনেক সময় যুদ্ধের কবলেও পড়ে যেতো, তাদের ব্যাপারটি ছিল মুসলমানদের জন্য অনেক বেশী পেরেশানির কারণ। এ ব্যাপারে একদিকে ইসলামী দলকে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয় এবং অন্যদিকে ঐ মুসলমানদেরকেও সবদিক থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

ইহুদীদের মধ্যে বিশেষ করে বনী নাযীরের মনোভাব ও কার্যধারা অত্যন্ত বিরোধমূলক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সব রকমের চুক্তির খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে ইসলামের শক্রদের সাথে সহযোগিতা করতে থাকে এবং মদীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। তাদের এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয় এবং এরপরই মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কারের কাজটি সমাধা করা হয়।

মুনাফিকদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন্ ধরনের মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা হবে, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই এদের সবাইকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শ্রেণীর মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা বলে দেয়া হয়েছে।

চুক্তিবদ্ধ নিরপেক্ষ গোত্রসমূহের সাথে মুসলমানদের কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তাও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।

মুসলমানদের নিজেদের চরিত্রকে ত্রুটিমুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ সংঘাত সংঘর্ষে এ ক্ষুদ্র দলটি একমাত্র নিজের উন্নত নৈতিক চরিত্র বলেই জয়লাভ করতে সক্ষম ছিল। এছাড়া তার জন্য জয়লাভের আর কোন উপায় ছিল না। তাই মুসলমানদেরকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের দলের মধ্যে যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করা হয়েছে।

ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের দিকটিও এ সূরায় বাদ যায়নি। জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম দুনিয়াকে যে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংশোধনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিল, তাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে এ সূরায় ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিক এ তিনটি সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাদের সামনে একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।

وَإِذَا ضَرَبْتُمْ فِى ٱلْأَرْضِ فَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ أَن تَقْصُرُوا۟ مِنَ ٱلصَّلَوٰةِ إِنْ خِفْتُمْ أَن يَفْتِنَكُمُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوٓا۟ ۚ إِنَّ ٱلْكَـٰفِرِينَ كَانُوا۟ لَكُمْ عَدُوًّۭا مُّبِينًۭا﴿١٠١ وَإِذَا كُنتَ فِيهِمْ فَأَقَمْتَ لَهُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَلْتَقُمْ طَآئِفَةٌۭ مِّنْهُم مَّعَكَ وَلْيَأْخُذُوٓا۟ أَسْلِحَتَهُمْ فَإِذَا سَجَدُوا۟ فَلْيَكُونُوا۟ مِن وَرَآئِكُمْ وَلْتَأْتِ طَآئِفَةٌ أُخْرَىٰ لَمْ يُصَلُّوا۟ فَلْيُصَلُّوا۟ مَعَكَ وَلْيَأْخُذُوا۟ حِذْرَهُمْ وَأَسْلِحَتَهُمْ ۗ وَدَّ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ لَوْ تَغْفُلُونَ عَنْ أَسْلِحَتِكُمْ وَأَمْتِعَتِكُمْ فَيَمِيلُونَ عَلَيْكُم مَّيْلَةًۭ وَٰحِدَةًۭ ۚ وَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ إِن كَانَ بِكُمْ أَذًۭى مِّن مَّطَرٍ أَوْ كُنتُم مَّرْضَىٰٓ أَن تَضَعُوٓا۟ أَسْلِحَتَكُمْ ۖ وَخُذُوا۟ حِذْرَكُمْ ۗ إِنَّ ٱللَّهَ أَعَدَّ لِلْكَـٰفِرِينَ عَذَابًۭا مُّهِينًۭا﴿١٠٢ فَإِذَا قَضَيْتُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَٱذْكُرُوا۟ ٱللَّهَ قِيَـٰمًۭا وَقُعُودًۭا وَعَلَىٰ جُنُوبِكُمْ ۚ فَإِذَا ٱطْمَأْنَنتُمْ فَأَقِيمُوا۟ ٱلصَّلَوٰةَ ۚ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ كَانَتْ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ كِتَـٰبًۭا مَّوْقُوتًۭا﴿١٠٣ وَلَا تَهِنُوا۟ فِى ٱبْتِغَآءِ ٱلْقَوْمِ ۖ إِن تَكُونُوا۟ تَأْلَمُونَ فَإِنَّهُمْ يَأْلَمُونَ كَمَا تَأْلَمُونَ ۖ وَتَرْجُونَ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا يَرْجُونَ ۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا﴿١٠٤ إِنَّآ أَنزَلْنَآ إِلَيْكَ ٱلْكِتَـٰبَ بِٱلْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ ٱلنَّاسِ بِمَآ أَرَىٰكَ ٱللَّهُ ۚ وَلَا تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًۭا﴿١٠٥
(১০১) আর যখন তোমরা সফরে বের হও তখন নামায সংক্ষেপ করে নিলে কোন ক্ষতি নেই।১৩২ (বিশেষ করে) যখন তোমাদের আশঙ্কা হয় যে, কাফেররা তোমাদেরকে কষ্ট দেবে।১৩৩ কারণ তারা প্রকাশ্যে তোমাদের শত্রুতা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। (১০২) আর হে নবী! যখন তুমি মুসলমানদের মধ্যে থাকো এবং (যুদ্ধাবস্থায়) তাদেরকে নামায পড়াবার জন্য দাঁড়াও১৩৪ তখন তাদের মধ্য থেকে একটি দলের তোমার সাথে দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিত১৩৫ এবং তারা অস্ত্রসস্ত্র সঙ্গে নেবে। তারপর তারা সিজদা করে নিলে পেছনে চলে যাবে এবং দ্বিতীয় দলটি, যারা এখনো নামায পড়েনি, তারা এসে তোমার সাথে নামায পড়বে। আর তারাও সতর্ক থাকবে এবং নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র বহন করবে।১৩৬ কারণ কাফেররা সুযোগের অপেক্ষায় আছে, তোমরা নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র ও জিনিস পত্রের দিক থেকে সামান্য গাফেল হলেই তারা তোমাদের ওপর অকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে যদি তোমরা বৃষ্টির কারণে কষ্ট অনুভব করো অথবা অসুস্থ থাকো, তাহলে অস্ত্র রেখে দিলে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু তবুও সতর্ক থাকো। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ‌ কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনাকর আযাবের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।১৩৭ (১০৩) তারপর তোমরা নামায শেষ করার পর দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সব অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আর মানসিক প্রশান্তি লাভ করার পর পুরো নামায পড়ে নাও। আসলে নামায নির্ধারিত সময়ে পড়ার জন্য মুমিনদের ওপর ফরয করা হয়েছে। (১০৪) এই দলের ১৩৮ পশ্চাদ্ধাবনে তোমরা দুর্বলতা প্রদর্শন করো না। যদি তোমরা যন্ত্রণা ভোগ করে থাকো তাহলে তোমাদের মতো তারাও যন্ত্রণা ভোগ করেছে। আর তোমরা আল্লাহর কাছে এমন জিনিস আশা করো, যা তারা আশা করে না।১৩৯ আল্লাহ সবকিছু জানেন, তিনি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। (১০৫) হে নবী!১৪০ আমি সত্য সহকারে এই কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে আল্লাহ‌ তোমাকে যে সঠিক পথ দেখিয়েছেন সেই অনুযায়ী তুমি লোকদের মধ্যে ফায়সালা করতে পারো। তুমি খেয়ানতকারী ও বিশ্বাস ভংগকারীদের পক্ষ থেকে বিতর্ককারী হয়ো না।
১৩২) যেসব ওয়াক্তে চার রাকআত নামায ফরয সেসব ওয়াক্তে ফরয নামায দুই রাকআত পড়াই হচ্ছে শান্তির সময়ের সফরের কসর। আর যুদ্ধের সময়ে কসর করার ব্যাপারে কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই। যুদ্ধের অবস্থায় যেভাবে সম্ভব নামায পড়ে নিতে হবে। জামায়াতে পড়ার সুযোগ থাকলে জামায়াতে পড়ে নিতে হবে। অন্যথায় ব্যক্তিগতভাবে একা একা পড়ে নিতে হবে। কিবলার দিকে মুখ করে পড়া সম্ভব না হলে যে দিকে মুখ করে পড়া সম্ভব সেদিকে মুখ করে পড়তে হবে। সাওয়ারীর পিঠে বসে চলন্ত অবস্থায়ও পড়া যেতে পারে। রুকূ’ ও সিজদা করা সম্ভব না হলে ইশারায় পড়তে হবে। প্রয়োজন হলে নামায পড়া অবস্থায় হাটতেও পারে। কাপড়ে রক্ত লেগে থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। এতো সব সহজ ব্যবস্থার পরও যদি অবস্থা এতই বিপদজ্জনক হয়, যার ফলে নামায পড়া সম্ভবপর না হয়ে থাকে, তাহলে বাধ্য হয়ে নামায পিছিয়ে দিতে হবে। যেমন খন্দকের যুদ্ধের সময় হয়েছিল।

সফরে কি কেবল ফরয পড়া হবে, না সুন্নতও পড়া হবে-এ ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। নবী ﷺ থেকে যা কিছু প্রমাণিত তা হচ্ছে এই যে, তিনি সফরে ফজরের সুন্নাত ও এশার বেতের নিয়মিত পড়তেন কিন্তু অন্যান্য ওয়াক্তে কেবল ফরয পড়তেন। নিয়মিত সুন্নাত পড়া তাঁর থেকে প্রমাণিত হয়নি। তবে নফল নামাযের যখনই সুযোগ পেতেন পড়ে নিতেন। এমনকি সাওয়ারীর পিঠে বসেও নফল নামায পড়তেন। এজন্যই হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) লোকদের সফরে ফজর ছাড়া অন্য ওয়াক্তে সুন্নাতগুলো জায়েয গণ্য করেছেন এবং অধিকাংশ উলামা সুন্নত ও নফল পড়া বা না পড়া উভয়টি জায়েয গণ্য করেছেন এবং ব্যক্তি ইচ্ছার ওপর তা ছেড়ে দিয়েছেন। হানাফী মাযহাবের সর্বজন গৃহীত মতটি হচ্ছে, মুসাফির যখন পথে চলমান অবস্থায় থাকে তখন তার সুন্নাত না পড়াই উত্তম আর যখন কোন স্থানে অবস্থান করতে থাকে এবং সেখানে নিশ্চিন্ত পরিবেশ বিরাজ করে, সে ক্ষেত্রে সুন্নাত পড়াই উত্তম।

যে সফরে কসর করা যেতে পারে সে সম্পর্কে কোন কোন ইমাম শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা হতে হবে ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে। যেমন জিহাদ, হজ্জ, উমরাই ইসলামী জ্ঞান আহরণ ইত্যাদি। ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ ও আতা এরই ওপর ফতোয়া দিয়েছেন। ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আহমাদ বলেন, সফর এমন কোন উদ্দেশ্যে হতে হবে যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে জায়েয। হারাম ও নাজায়েয উদ্দেশ্য সামনে রেখে যে সফর করা হয় তাতে কসরের অনুমতির সুবিধা ভোগ করার অধিকার কারোর নেই। হানাফীদের মতে যে কোন সফরে কসর করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সফরের ধরণ সম্পর্কে বলা যায়, তা নিজেই সওয়াব বা আযাবের অধিকারী হতে পারে। কিন্তু কসরের অনুমতির ওপর তার কোন প্রভাব পড়ে না।

কোন কোন ইমাম “কোন ক্ষতি নেই” (فليس عليكم جاناح) বাক্যটি থেকে এ অর্থ নিয়েছেন যে, সফরে কসর করা জরুরী নয়। বরং সফরে কসরের নিছক অনুমতিই দেয়া হয়েছে। ব্যক্তি চাইলে এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারে আবার চাইলে পুরো নামায পড়তে পারে। ইমাম শাফেঈ এ মতটি গ্রহণ করেছেন, যদিও তিনি কসর করাকে উত্তম এবং কসর না করাকে উত্তম কাজ ত্যাগ করার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইমাম আহমাদের মতে কসর করা ওয়াজিব। একটি বর্ণনা মতে ইমাম মালিকেরও এই একই মত উদ্ধৃত হয়েছে। নবী ﷺ হামেশা সফরে কসর করেছেন, এটা হাদীস থেকে প্রমাণিত। কোন নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয়নি যে, তিনি সফরে কখনো চার রাকাআত ফরয পড়েছেন। ইবনে উমর বলেনঃ আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর, উমর ওসমান রাদিআল্লাহু আনহুমের সাথে সফর করেছি। আমি কখনো তাদের সফরে কসর না করতে দেখিনি। এরই সমর্থনে ইবনে আব্বাস এবং আরো অসংখ্য সাহাবীর নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াত উদ্ধৃত হয়েছে। হযরত উসমান যখন হজ্জের সময় মীনায় চার রাকাআত পড়ালেন তখন সাহাবীগণ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন। হযরত উসমান তখন এই জবাব দিয়ে লোকদের নিশ্চিন্ত করলেনঃ আমি মক্কায় বিয়ে করেছি আর যেহেতু নবী ﷺ থেকে আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি কোন শহরে পারিবারিক জীবন শুরু করে সে যেন সেই শহরের অধিবাসী। তাই আমি এখানে কসর করিনি। এই রেওয়ায়াতগুলোর বিরুদ্ধে হযরত আয়েশা থেকে এমন দু’টি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে যা থেকে জানা যায় যে, কসর করা বা পূর্ণ নামায পড়া উভয়টিই ঠিক কিন্তু এই রেওয়ায়াতগুলো সনদের দিক দিয়ে দুর্বল হবার সাথে সাথে হযরত আয়েশার (রা.) নিজের থেকে প্রমাণিত মতেরও বিরোধী। তবে একথা সত্য যে, সফরে ও অ-সফরের মাঝামাঝি একটি অবস্থা রয়েছে। সে অবস্থায় একই অস্থায়ী নিবাসে সুবিধা মতো কখনো কসর করা যেতে পারে আবার কখনো পুরো নামায পড়ে নেয়া যেতে পারে। সম্ভবত হযরত আয়েশা (রা.) এই অবস্থাটি সম্পর্কে বলেছেন যে, নবী ﷺ সফরে কসর করেছেন আবার পুরো নামাযও পড়েছেন। আর কুরআনের এই “সফরে কসর করলে ক্ষতি নেই” বাক্যটি এক্ষেত্রে কোন নতুন কথা নয়। ইতিপূর্বে সূরা বাকারার ১৯ রুকু’তেও সাফা ও মারাওয়া পাহাড় দু’টির মাঝখানে ‘সাঈ’ করার নির্দেশও এই একই ভাষায় দেয়া হয়েছে অথচ এই ‘সাঈ’ ‘মানাসিকে হজ্জ’ অর্থাৎ হজ্জের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত এবং ওয়াজিব। আসলে এই উভয় স্থানেই লোকদের মনের একটাআশঙ্কা দূর করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। সেই আশঙ্কাটি ছিল এই যে, এ ধরনের কাজে কোন গোনাহ হবে নাতো বা এতে সওয়াবে কোন কমতি দেখা দেবে না তো! এ ধরনের আশঙ্কা দূর করার উদ্দেশ্যেই এ স্থানে এ বর্ণনাভংগী গ্রহণ করা হয়েছে।

কি পরিমাণ দূরত্বের সফর হলে তাতে কসর করা যেতে পারে? এ ব্যাপারে ‘ যাহেরী ফিকাহ’-এর মত হচ্ছে এর কোন পরিমাণ নেই। কম বা বেশী যে কোন দূরত্বের সফর হোক না কেন তাতে কসর করা যেতে পারে। ইমাম মালিকের মতে ৪৮ মাইল বা এক দিন রাতের কম সময়ের সফরে কসর নেই। ইমাম আহমাদও একই মত পোষণ করেন। ইবনে আব্বাস(রা.) ও এই মত পোষণ করতেন। ইমাম শাফেঈর একটি বিবৃতিতে এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়। হযরত আনাস (রা.) ১৫ মাইলের সফরে কসর জায়েয মনে করেন। “একদিনের সফর কসর করার জন্য যথেষ্ট” হযরত উমরের (রা.)) এই মত ইমাম আওয়াযী ও ইমাম যুহ্‌রী গ্রহণ করেছেন। হাসান বসরী দুই দিন এবং ইমাম আবু ইউসুফ দুই দিনের বেশী দুরত্বের সফরে কসর জায়েয মনে করেন। ইমাম আবু হানীফার মতে পায়ে হেঁটে বা উটের পিঠে চড়ে তিন দিন সফর করে যে দুরত্ব অতিক্রম করা যা (অর্থাৎ প্রায় ১৮ ফরসঙ্গ বা ৫৪ মাইল) তাতে কসর করা যেতে পারে। ইবনে উমর, ইবনে মাসউদ ও হযরত উসমান রাদি আল্লাহু আনহুম এই মত পোষণ করেন।

সফরের মাঝখানে কোথাও অবস্থান করলে কতদিন পর্যন্ত কসর করা যেতে পারে-এ ব্যাপারেও ইমামগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ইমাম আহমাদের মতে যেখানে ৪ দিন অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে সেখানে পুরা নামায পড়তে হবে। ইমাম মালেক ও ইমাম সাফেঈর মতে যেখানে ৪ দিনের বেশী সময় অবস্থানের নিয়ত থাকে সেখানে কসর করা জায়েয নয়। ইমাম আওযায়ী ১৩ দিনের ও ইমাম আবু হানীফা ১৫ দিনের অথবা তার চেয়ে বেশী দিন অবস্থান করার নিয়ত করলে পুরা নামায পড়ার হুকুম দিয়েছেন। এ অধ্যায়ে নবী ﷺ থেকে কোন সুস্পষ্ট বিধান বর্ণিত হয়নি। আর যদি কোন স্থানে এক ব্যক্তি বাধ্য হয়ে আটকে পড়ে এবং সবসময় তার খেয়াল থাকে যে, বাধা দূর হলেই সে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হবে, তাহলে এমন স্থানে সে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কসর করতে থাকবে। এ ব্যাপারে সমস্ত উলামায়ে কেরাম একমত। সাহাবায়ে কেরামদের থেকে এমন অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যা থেকে জানা যায়, তাঁরা এ ধরনের অবস্থায় দুই দুই বছর পর্যন্ত অনবরত কসর করেছেন। এরই ওপর কিয়াস করে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল কয়েদীকেও তার সমগ্র মেয়াদব্যাপী কসর করার অনুমতি দিয়েছেন।

১৩৩) ‘যাহেরী’ ও ‘খারেজী’ ফিকাহর অনুসারীরা এ বাক্যের যে অর্থ গ্রহণ করে থাকে তা হচ্ছে, কসর কেবল যুদ্ধাবস্থার জন্য আর শান্তির অবস্থায় যে সফর করা হয় তাতে কসর করা কুরআন বিরোধী। কিন্তু নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়াতের মাধ্যমে হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, হযরত উমর (রা.) এই একই সন্দেহটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সামনে পেশ করলে তিনি এর জবাবে বলেনঃصَدَقَةً تَصدَّقَ الله بِهَا عَلَيكُم فَقبَلُوا صَدَقَتَهُঅর্থাৎ “এই নামাযে কসর করার অনুমতিটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পুরস্কার। আল্লাহ‌ তোমাদের এই পুরস্কার দান করেছেন। কাজেই তোমরা এ পুরস্কারটি গ্রহণ করো।” নবী ﷺ শান্তি ও ভয় উভয় অবস্থায়ই সফরের নামযে কসর করেছেন। একথা প্রায় ‘মুতাওয়াতির’ বা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত হাদীসের মধ্যমে প্রমাণিত সত্য। ইবনে আব্বাস (রা.) সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ

أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم خَرَجَ مِنَ الْمَدِينَةِ إِلَى مَكَّةَ لاَ يَخَافُ إِلاَّ رَبَّ الْعَالَمِينَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ-

অর্থাৎ “নবী ﷺ মদীনা থেকে মক্কার দিকে বের হলেন। সে সময় একমাত্র রব্বুল আলামীন ছাড়া আর কারোর ভয় ছিল না। কিন্তু তিনি নামায দুই রাকআত পড়লেন।” এজন্য আমি তরজমায় বন্ধনীর মধ্যে “বিশেষ করে” শব্দটি বাড়িয়ে দিয়েছি।

১৩৪) ইমাম আবু ইউসুফ ও হাসান বিন যিয়াদ এই শব্দাবলী থেকে এ ধারণা নিয়েছেন যে, “সালাতে খওফে”র (ভয়ের নামায) কেবলমাত্র নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে একটি হুকুম দেয়া হয়েছে আবার সেই হুকুমটিই তাঁর পরে তার স্থলাভিষিক্তদের জন্যও আগের মতই কার্যকর রয়েছে, কুরআন মজীদে এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। কাজেই “সালাতে খওফ”কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে নির্দিষ্ট করার কোন কারণ নেই। এছাড়াও অসংখ্য নেতৃস্থানীয় সাহাবী থেকেও একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, তাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরেও ‘ সালাতে খওফ’ পড়েছেন। এ প্রশ্নে কোন সাহাবীর মতবিরোধের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
১৩৫) শত্রুর আক্রমণের ভয় আছে কিন্তু কার্যত লড়াই হচ্ছে না, এমন অবস্থায় ‘সালাতে খওফে’র (ভয়ের নামায) হুকুম দেয়া হয়েছে। আর কার্যত যখন লড়াই চলছে তেমন অবস্থায় হানাফীদের মতে নামায পিছিয়ে দেয়া হবে। ইমাম মালেক ও ইমাম সুফিয়ান সওরীর মতে রুকু’ ও সিজদা করা সম্ভব না হলে ইশারায় নামায পড়ে নিতে হবে। ইমাম শাফেঈর মতে, নামাযের মধ্যেও কিছুটা যুদ্ধ করা যেতে পারে। নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত যে, তিনি খন্দকের যুদ্ধের সময় চার ওয়াক্তের নামায পড়েননি। তারপর সুযোগ পেয়েই তরতীব অনুযায়ী চার ওয়াক্তের নামায এক সাথে পড়ে নেন। অথচ খন্দকের যুদ্ধের আগেই ‘সালাতে খওফে’র হুকুম এসে গিয়েছিল।
১৩৬) অনেকটা যুদ্ধের অবস্থার ওপর ‘সালাত খওফ’ পড়ার পদ্ধতি নির্ভর করে। নবী ﷺ বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ নামায পড়িয়েছেন। কাজেই যুদ্ধের অবস্থা বা পরিস্থিতি ঐ পদ্ধতিগুলোর মধ্য থেকে যেটির অনুমতি দেবে তৎকালীন ইসলামী দলের প্রধান সেই পদ্ধতিতেই নামায পড়াবেন।

এর একটি পদ্ধতি হচ্ছেঃ সেনাদলের একটি অংশ ইমামের সাথে নামায পড়বে এবং অন্য অংশটি তখন দুশমনের মোকাবিলা করতে থাকবে। যখন এক রাকআত পুরা হয়ে যাবে তখন প্রথম অংশটি সালাম ফিরে চলে যাবে এবং দ্বিতীয় অংশটি এসে ইমামের সাথে দ্বিতীয় রাকআতটি পুরা করবে। এভাবে ইমামের দু’রাকআত এবং সৈন্যদের এক রাকআত নামায হবে।

দ্বিতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ সেনাদলের এক অংশ ইমামের সাথে এক রাকআত পড়ে চলে যাবে তারপর দ্বিতীয় অংশটি এসে ইমামের পেছনে এক রাকআত পড়বে। এরপর উভয় অংশই পালাক্রমে এসে নিজেদের বাকি এক রাকআত একা একা পড়ে নেবে। এভাবে উভয় অংশের এক রাকআত পড়া হবে ইমামের পিছনে এবং এক রাকআত হবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে।

এর তৃতীয় পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ ইমামের পেছনে সেনাদলের একটি অংশ দুই রাকআত পড়বে এবং তাশাহ্‌হুদের পর সালাম ফিরে চলে যাবে। সেনাদলের দ্বিতীয় অংশ ইমামের সাথে তৃতীয় রাকআতে শরীক হবে এবং তার সাথে আর এক রাকআত করে পড়ে সালাম ফিরবে। এভাবে ইমামের চার ও সেনাদলের দুই রাকআত হবে।

চতুর্থ পদ্ধতিটি হচ্ছেঃ সেনাদলের এক অংশ ইমামের সাথে এক রাকআত পড়বে এবং ইমাম যখন দ্বিতীয় রাকআতের জন্য দাঁড়াবে তখন মুকতাদীরা নিজেরাই একা একা দ্বিতীয় রাকআত তাশাহহুদ সহ পড়ে সালাম ফিরে চলে যাবে। তারপর দ্বিতীয় অংশটি এসে এমন অবস্থায় ইমামের সাথে শামিল হবে যে ইমাম তখনো দ্বিতীয় রাকআতে থাকবেন এবং এরা বাকি নামায ইমামের সাথে পড়ার পর এক রাকআত নিজেরা উঠে একা একা পড়ে নেবে। এ অবস্থায় ইমামকে দ্বিতীয় রাকআতে দীর্ঘতম কিয়াম করতে হবে।

ইবনে আব্বাস, জাবির ইবনে আবদুল্লাহু ও মুজাহিদ প্রথম পদ্ধতিটি সম্পর্কে রেওয়ায়াত করেছেন। দ্বিতীয় পদ্ধতিটি সম্পর্কে রেওয়ায়াত করেছেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ। হানাফীগণ এই দ্বিতীয় পদ্ধতিটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তৃতীয় পদ্ধতিটি রেওয়ায়াত করেছেন হাসান বসরী আবু বাকরাহ থেকে। আর চতুর্থ পদ্ধতিটিকে সামান্য একটু মতবিরোধ সহকারে ইমাম শাফেঈ ও ইমাম মালেক অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর উৎস হচ্ছে সাহ্‌ল ইবনে আবী হাস্‌মার একটি রেওয়ায়াত।

এগুলো ছাড়া সালাতে খওফের আরো কয়েকটি পদ্ধতি আছে। ফিকাহর কিতাবগুলোয় এগুলোর আলোচনা পাওয়া যাবে।

১৩৭) অর্থাৎ তোমাদের এই যে সতর্কতার হুকুম দেয়া হচ্ছে এটা নিছক একটা পার্থিব কৌশল। নয়তো আসলে জয়-পরাজয় তোমাদের কৌশলের ওপর নির্ভর করে না। বরং তা নির্ভর করে আল্লাহর ফায়সালার ওপর। তাই এই সতর্কতামূলক কৌশল ও পদক্ষেপগুলো কার্যকর করার সময় তোমাদের একথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে, যারা নিজেদের মুখের ফুঁৎকারে আল্লাহর আলো নিবিয়ে দিতে চাচ্ছে আল্লাহ‌ তাদের লাঞ্ছিত করবেন।
১৩৮) অর্থাৎ কাফের দল। এ দলটি সে সময় ইসলামী দাওয়াত ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা ও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
১৩৯) অর্থাৎ কাফেররা বাতিলের জন্য যে পরিমাণ কষ্ট স্বীকার করছে ঈমানদাররা যদি হকের জন্য অন্তত এতটুকু কষ্টও বরদাশ্‌ত করতে না পারে তাহলে তা হবে সত্যিই বিস্ময়কর। অথচ কাফেরদের সামনে কেবল দুনিয়া ও তার ক্ষণস্থায়ী স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নেই। বিপরীতপক্ষে ঈমানদাররা আকাশ ও পৃথিবীর প্রভু পরওয়ারদিগারের সন্তুষ্টি, নৈকট্য ও তাঁর চিরন্তন পুরস্কার লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে আসছে।
১৪০) এই রুকূ’ এবং এর পরবর্তী রুকূ’তে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে। ব্যাপারটি সেই যুগেই সংঘটিত হয়। ঘটনার নায়ক হচ্ছে আনসারদের যাফর গোত্রের তা’মাহ্ বা বশীর ইবনে উবাইরিক নামক এক ব্যক্তি। সে এক আনসারির বর্ম চুরি করে। এ ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হলে সে চোরাই মালটি এক ইহুদীর কাছে রাখে। বর্মের মালিক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অভিযোগ করে এবং তা’মাহকে সন্দেহ করে। কিন্তু তা’মাহ, তার ভাই বেরাদাররা এবং বনি যাফরের আরো বহু লোক নিজেদের মধ্যে একমত হয়ে সেই ইহুদীটির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে। ইহুদীকে জিজ্ঞেস করা হলে সে নিজের নির্দোষিতা প্রকাশ করে কিন্তু তা’মাহর পক্ষপাতিরা তার সমর্থনে খুব জোরেশোরে এগিয়ে যায়। তারা বলতে থাকেঃ এই শয়তান ইহুদী, সেতো সত্যকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ‌ ও তাঁর রসূলের সাথে কুফরী করে, তার কথা কেমন করে বিশ্বাসেযাগ্য হতে পারে? বরং আমাদের কথা মেনে নেয়া উচিত কারণ আমরা মুসলমান। এই মোকাদ্দমার বাহ্যিক ধারা বিবরণীতে প্রভাবিত হয়ে নবী করীম ﷺ ইহুদীটির বিরুদ্ধে রায় দিতে এবং অভিযোগকারীকে বনী উবাইরিকের বিরুদ্ধে দোষারোপ করার জন্য সতর্ক করে দিতে প্রায় উদ্যত হয়েছিলেন। এমন সময় অহী নাযিল হয় এবং সমস্ত ব্যাপারটির প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করে দেয়া হয়।

একজন বিচারপতি হিসেবে বাহ্যিক যুক্তি প্রমাণ ও সাক্ষী সাবুদের ভিত্তিতে মোকদ্দমার মীমাংসা করা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য কোন গোনাহের কাজ ছিল না। এ ধরনের অবস্থা বিচারপতিদের সামনে আসেও। অর্থাৎ মিথ্যা প্রমাণ ও সাক্ষী সাবুদের ভিত্তিতে তাদের কাছে থেকে নিজেদের সপক্ষে রায় নিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু সে সময় ইসলাম ও কুফরের মধ্যে একটি প্রচণ্ড সংঘাত চলছিল। এমন সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি মোকদ্দমার বাহ্যিক ধারা বিবরণী শুনে সেই অনুযায়ী ইহুদীর বিরুদ্ধে ফয়সালা করে দিতেন তাহলে ইসলাম বিরোধীরা তার বিরুদ্ধে এবং সমগ্র ইসলামী দল ও ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে একটি মারাত্মক শক্তিশালী নৈতিক হাতিয়ার পেয়ে যেতো। তারা প্রপাগাণ্ডা করতে থাকতোঃ আহা, যাই বলেন না কেন, এখানে হক ও ইনসাফের কোন বালাই নেই। এখানেও তো সেই একই দলপ্রীতি ও অন্ধ গোত্রপ্রীতি কাজ করছে যার বিরুদ্ধে এরা নিজেরাই প্রচার অভিযান চালিয়ে আসছে। এই বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য আল্লাহ‌ বিশেষ করে এই মোকদ্দমায় হস্তক্ষেপ করেন।

এই রুকূ’তে একদিকে সেসব মুসলমানদের কঠোরভাবে ভর্ৎসনা করা হয়েছে যারা নিছক অন্ধ গোত্র ও পরিবার প্রীতির কারণে অপরাধীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। অন্যদিকে সাধারণ মুসলমানদের এই মর্মে শিক্ষা দান করা হয়েছে যে, ন্যায় ও ইনসাফের প্রশ্নে কোনো প্রকার অন্ধ বিদ্বেষ ও কওম প্রীতির অবকাশ না থাকাই উচিত। নিজের দলের লোকেরা বাতিলের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের অযথা সমর্থন করতে হবে এবং অন্য দলের লোকেরা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তাদের প্রতি অন্যায় করতে হবে-এ নীতি কখনো ন্যায়সঙ্গত হতেপারে না।