আন্ নিসা

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নাযিল হওয়ার সময়-কাল ও বিষয়বস্তু

এ সূরাটি কয়েকটি ভাষণের সমষ্টি। সম্ভবত তৃতীয় হিজরীর শেষের দিক থেকে নিয়ে চতুর্থ হিজরীর শেষের দিকে অথবা পঞ্চম হিজরীর প্রথম দিকের সময়-কালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে এর বিভিন্ন অংশ নাযিল হয়। যদিও নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না, কোন আয়াত থেকে কোন আয়াত পর্যন্ত একটি ভাষণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে নাযিল হয়েছিল এবং তার নাযিলের সময়টা কি ছিল, তবুও কোন কোন বিধান ও ঘটনার দিকে কোথাও কোথাও এমন সব ইঙ্গিত করা হয়েছে যার সহায়তায় রেওয়ায়াত থেকে আমরা তাদের নাযিলের তারিখ জানতে পারি। তাই এগুলোর সাহায্যে আমরা এসব বিধান ও ইঙ্গিত সম্বলিত এ ভাষণগুলোর মোটামুটি একটা সীমা নির্দেশ করতে পারি।

যেমন আমরা জানি উত্তরাধিকার বন্টন ও এতিমদের অধিকার সম্বলিত বিধানসমূহ ওহোদ যুদ্ধের পর নাযিল হয়। তখন সত্তর জন মুসলমান শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনাটির ফলে মদীনার ছোট জনবসতির বিভিন্ন গৃহে শহীদদের মীরাস কিভাবে বন্টন করা হবে এবং তারা যেসব এতিম ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন তাদের স্বার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এ প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরই ভিত্তিতে আমরা অনুমান করতে পারি, প্রথম চারটি রুকু, ও পঞ্চম রুকূর প্রথম তিনটি আয়াত এ সময় নাযিল হয়ে থাকবে।

যাতুর রিকা’র যুদ্ধে ভয়ের নামায (যুদ্ধ চলা অবস্থায় নামায পড়া) পড়ার রেওয়ায়াত আমরা হাদীসে পাই। এ যুদ্ধটি চতুর্থ হিজরীতে সংঘটিত হয়। তাই এখানে অনুমান করা যেতে পারে, যে ভাষণে (১৫ রুকূ’) এ নামাযের নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে সেটি এরই কাছাকাছি সময়ে নাযিল হয়ে থাকবে।

চতুর্থ হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে মদীনা থেকে বনী নযীরকে বহিষ্কার করা হয়। তাই যে ভাষণটিতে ইহুদীদেরকে এ মর্মে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, আমি তোমাদের চেহারা বিকৃত করে পেছন দিকে ফিরিয়ে দেবার আগে ঈমান আনো, সেটি এর পূর্বে কোন নিকটতম সময়ে নাযিল হয়েছিল বলে শক্তিশালী অনুমান করা যেতে পারে।

বনীল মুসতালিকের যুদ্ধের সময় পানি না পাওয়ার কারণে তায়াম্মুমের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর এ যুদ্ধটি পঞ্চম হিজরীতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই যে ভাষণটিতে (৭ম রুকূ’) তায়াম্মুমের কথা উল্লেখিত হয়েছিল সেটি এ সময়ই নাযিল হয়েছিল মনে করতে হবে।

নাযিল হওয়ার কারণ ও আলোচ্য বিষয়

এভাবে সামগ্রিক পর্যায়ে সূরাটি নাযিল হওয়ার সময়-কাল জানার পর আমাদের সেই যুগের ইতিহাসের ওপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়া উচিত। এর সাহায্যে সূরাটি আলোচ্য বিষয় অনুধাবন করা সহজসাধ্য হবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে সে সময় যেসব কাজ ছিল সেগুলোকে তিনটি বড় বড় বিভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে। এক, একটি নতুন ইসলামী সমাজ সংগঠনের বিকাশ সাধন। হিজরতের পরপরই মদীনা তাইয়েবা ও তার আশেপাশের এলাকায় এ সমাজের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে জাহেলিয়াতের পুরাতন পদ্ধতি নির্মূল করে নৈতিকতা, তামাদ্দুন, সমাজরীতি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা নতুন নীতি-নিয়ম প্রচলনের কর্মতৎপরতা এগিয়ে চলছিল। দুই, আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদী গোত্রসমূহ ও মুনাফিকদের সংস্কার বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে ইসলামের যে ঘোরতর সংঘাত চলে আসছিল তা জারী রাখা। তিন, এ বিরোধী শক্তিগুলোর সকল বাধা উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকা এবং এ জন্য আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করে সেখানে ইসলামকে বিজয়ীর আসনে প্রতিষ্ঠিত করা। এ সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে যতগুলো ভাষণ অবতীর্ণ হয়, তা সবই এই তিনটি বিভাগের সাথে সম্পর্কিত।

ইসলামের সামাজিক কাঠামো নির্মাণ এবং বাস্তবে এ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম অবস্থায় যে সমস্ত নির্দেশ ও বিধানের প্রয়োজন ছিল সূরা বাকারায় সেগুলো প্রদান করা হয়েছিল। বর্তমানে এ সমাজ আগের চাইতে বেশী সম্প্রসারিত হয়েছে। কাজেই এখানে আরো নতুন নতুন বিধান ও নির্দেশের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য সূরা নিসার এ ভাষণগুলোতে মুসলমানরা কিভাবে ইসলামী পদ্ধতিতে তাদের সামাজিক জীবনধারার সংশোধন ও সংস্কার সাধন করতে পারে তা আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে পরিবার গঠনের নীতি বর্ণনা করা হয়েছে। বিয়েকে বিধি-নিষেধের আওতাধীন করা হয়েছে। সমাজে নারী ও পুরুষের সম্পর্কের সীমা নির্দেশ করা হয়েছে। এতিমদের অধিকার নির্দিষ্ট করা হয়েছে। মীরাস বন্টনের নিয়ম-কানুন নির্ধারিত হয়েছে। অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ঘরোয়া বিবাদ মিটাবার পদ্ধতি শিখানো হয়েছে। অপরাধ দণ্ডবিধির ভিত গড়ে তোলা হয়েছে। মদপানের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তাহারাত ও পাক-পবিত্রতা অর্জনের বিধান দেয়া হয়েছে। আল্লাহ ও বান্দার সাথে সৎ ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের কর্মধারা কেমন হতে পারে, তা মুসলমানদের জানানো হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দলীল সংগঠন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। আহলি কিতাবদের নৈতিক, ধর্মীয় মনোভাব ও কর্মনীতি বিশ্লেষণ করে মুসলমানদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন পূর্ববর্তী উম্মতদের পদাংক অনুসরণ করে চলা থেকে বিরত থাকে। মুনাফিকদের কর্মনীতির সমালোচনা করে যথার্থ ও খাঁটি ঈমানদারীর এবং ঈমান ও নিফাকের পার্থক্য সূচক চেহারা পুরোপুরি উন্মুক্ত করে রেখে দেয়া হয়েছে।

ইসলাম বিরোধী শক্তিদের সাথে যে সংঘাত চলছিল ওহোদ যুদ্ধের পর তা আরো নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছিল। ওহোদের পরাজয় আশপাশের মুশরিক গোত্রসমূহ, ইহুদী প্রতিবেশীবৃন্দ ও ঘরের শক্র বিভীষণ তথা মুনাফিকদের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুসলমানরা সবদিক থেকে বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। এ অবস্থায় মহান আল্লাহ একদিকে আবেগময় ভাষণের মাধ্যমে মুসলমানদেরকে বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করলেন এবং অন্যদিকে যুদ্ধাবস্থায় কাজ করার জন্য তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। মদীনায় মুনাফিক ও দুর্বল ঈমানদার লোকেরা সব ধরনের ভীতি ও আশংকার খবর ছড়িয়ে হতাশা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। এ ধরনের প্রত্যেকটি খবর দায়িত্বশীলদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার এবং কোন খবর সম্পর্কে পুরোপুরি অনুসন্ধান না করার আগে তা প্রচার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করার নির্দেশ দেয়া হয়।

মুসলমানদের বারবার যুদ্ধে ও নৈশ অভিযানে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় তাদের এমন সব পথ অতিক্রম করতে হতো যেখানে পানির চিহ্নমাত্রও পাওয়া যেতো না। সে ক্ষেত্রে পানি না পাওয়া গেলে ওযু ও গোসল দুয়ের জন্য তাদের তায়াম্মুম করার অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়াও এ অবস্থায় সেখানে নামায সংক্ষেপে করারও অনুমতি দেয়া হয়। আর যেখানে বিপদ মাথার ওপর চেপে থাকে সেখানে সালাতুল খওফ (ভয়কালীন নামায) পড়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়া হয়। আরবের বিভিন্ন এলাকায় যেসব মুসলমান কাফের গোত্রগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং অনেক সময় যুদ্ধের কবলেও পড়ে যেতো, তাদের ব্যাপারটি ছিল মুসলমানদের জন্য অনেক বেশী পেরেশানির কারণ। এ ব্যাপারে একদিকে ইসলামী দলকে বিস্তারিত নির্দেশ দেয়া হয় এবং অন্যদিকে ঐ মুসলমানদেরকেও সবদিক থেকে হিজরত করে দারুল ইসলামে সমবেত হতে উদ্বুদ্ধ করা হয়।

ইহুদীদের মধ্যে বিশেষ করে বনী নাযীরের মনোভাব ও কার্যধারা অত্যন্ত বিরোধমূলক ও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তারা সব রকমের চুক্তির খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে ইসলামের শক্রদের সাথে সহযোগিতা করতে থাকে এবং মদীনায় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। তাদের এসব কার্যকলাপের কঠোর সমালোচনা করা হয় এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাদেরকে সর্বশেষ সতর্কবাণী শুনিয়ে দেয়া হয় এবং এরপরই মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কারের কাজটি সমাধা করা হয়।

মুনাফিকদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন্ ধরনের মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করা হবে, এ সম্পর্কে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাই এদের সবাইকে আলাদা আলাদা শ্রেণীতে বিভক্ত করে প্রত্যেক শ্রেণীর মুনাফিকদের সাথে কোন্ ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তা বলে দেয়া হয়েছে।

চুক্তিবদ্ধ নিরপেক্ষ গোত্রসমূহের সাথে মুসলমানদের কোন ধরনের ব্যবহার করতে হবে, তাও সুস্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।

মুসলমানদের নিজেদের চরিত্রকে ত্রুটিমুক্ত করাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এ সংঘাত সংঘর্ষে এ ক্ষুদ্র দলটি একমাত্র নিজের উন্নত নৈতিক চরিত্র বলেই জয়লাভ করতে সক্ষম ছিল। এছাড়া তার জন্য জয়লাভের আর কোন উপায় ছিল না। তাই মুসলমানদেরকে উন্নত নৈতিক চরিত্রের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। তাদের দলের মধ্যে যে কোন দুর্বলতা দেখা দিয়েছে কঠোর ভাষায় তার সমালোচনা করা হয়েছে।

ইসলামের দাওয়াত ও প্রচারের দিকটিও এ সূরায় বাদ যায়নি। জাহেলিয়াতের মোকাবিলায় ইসলাম দুনিয়াকে যে নৈতিক ও তামাদ্দুনিক সংশোধনের দিকে আহবান জানিয়ে আসছিল, তাকে বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করার সাথে সাথে এ সূরায় ইহুদী, খৃস্টান ও মুশরিক এ তিনটি সম্প্রদায়ের ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা-বিশ্বাস, নৈতিক চরিত্র নীতি ও কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে তাদের সামনে একমাত্র সত্য দ্বীন ইসলামের দাওয়াত পেশ করা হয়েছে।

ٱلَّذِينَ يَتَرَبَّصُونَ بِكُمْ فَإِن كَانَ لَكُمْ فَتْحٌۭ مِّنَ ٱللَّهِ قَالُوٓا۟ أَلَمْ نَكُن مَّعَكُمْ وَإِن كَانَ لِلْكَـٰفِرِينَ نَصِيبٌۭ قَالُوٓا۟ أَلَمْ نَسْتَحْوِذْ عَلَيْكُمْ وَنَمْنَعْكُم مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۚ فَٱللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَكُمْ يَوْمَ ٱلْقِيَـٰمَةِ ۗ وَلَن يَجْعَلَ ٱللَّهُ لِلْكَـٰفِرِينَ عَلَى ٱلْمُؤْمِنِينَ سَبِيلًا﴿١٤١ إِنَّ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ يُخَـٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَـٰدِعُهُمْ وَإِذَا قَامُوٓا۟ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُوا۟ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذْكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلًۭا﴿١٤٢ مُّذَبْذَبِينَ بَيْنَ ذَٰلِكَ لَآ إِلَىٰ هَـٰٓؤُلَآءِ وَلَآ إِلَىٰ هَـٰٓؤُلَآءِ ۚ وَمَن يُضْلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلًۭا﴿١٤٣ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَتَّخِذُوا۟ ٱلْكَـٰفِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِن دُونِ ٱلْمُؤْمِنِينَ ۚ أَتُرِيدُونَ أَن تَجْعَلُوا۟ لِلَّهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَـٰنًۭا مُّبِينًا﴿١٤٤ إِنَّ ٱلْمُنَـٰفِقِينَ فِى ٱلدَّرْكِ ٱلْأَسْفَلِ مِنَ ٱلنَّارِ وَلَن تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا﴿١٤٥
(১৪১) এই মুনাফিকরা তোমাদের ব্যাপারে অপেক্ষা করছে। তারা দেখছে পানি কোন্‌ দিকে গড়ায়। যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের বিজয় সূচিত হয় তাহলে তারা এসে বলবে, আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না? আর যদি কাফেরদের পাল্লা ভারী থাকে তাহলে তাদেরকে বলবে, আমরা কি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সক্ষম ছিলাম না? এরপরও আমরা মুসলমানদের হাত থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছি।১৭১ কাজেই কিয়ামতের দিন তোমাদের ও তাদের ব্যাপারে ফায়সালা আল্লাহই করে দেবেন। আর (এই ফায়সালায়) আল্লাহ‌ কাফেরদের জন্য মুসলমানদের ওপর বিজয় লাভ করার কোন পথই রাখেননি। (১৪২) এই মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে ধোঁকাবাজি করছে। অথচ আল্লাহই তাদেরকে ধোঁকার মধ্যে ফেলে রেখে দিয়েছেন। তারা যখন নামাযের জন্য ওঠে, আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে শৈথিল্য সহকারে নিছক লোক দেখাবার জন্য ওঠে এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে।১৭২ (১৪৩) কুফর ও ঈমানের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায় থাকে, না পুরোপুরি এদিকে, না পুরোপুরি ওদিকে। যাকে আল্লাহ‌ পথভ্রষ্ট করে দিয়েছেন তার জন্য তুমি কোন পথ পেতে পারো না।১৭৩ (১৪৪) হে ঈমানদারগণ! মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না। তোমরা কি নিজেদের বিরুদ্ধে আল্লাহর হাতে সুস্পষ্ট প্রমাণ তুলে দিতে চাও? (১৪৫) নিশ্চিত জেনো, মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে চলে যাবে এবং তোমরা কাউকে তাদের সাহায্যকারী হিসেবে পাবে না।
১৭১) এটিই প্রত্যেক যুগের মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। মৌখিক স্বীকারোক্তি ও ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে নামমাত্র প্রবেশের মাধ্যমে মুসলমান হিসেবে যতটুকু স্বার্থ ভোগ করা যায় তা তারা ভোগ করে। আবার অন্যদিকে কাফের হিসেবে যে স্বার্থটুকু ভোগ করা সম্ভব তা ভোগ করার জন্য তারা কাফেরদের সাথে যোগ দেয়। তারা সর্বোতভাবে কাফেরদের বিশ্বাসভাজন হবার চেষ্টা করে। তাদেরকে বলেঃ আমরা মোটেই “গোঁড়া ও বিদ্বেষপরায়ণ” মুসলমান নই। মুসলমাদের সাথে আমাদের অবশ্যি নামের সম্পর্ক আছে কিন্তু আমাদের মানসিক ঝোক, আগ্রহ ও বিশ্বস্ততা রয়েছে তোমাদের প্রতি। চিন্তা –ভাবনা, আচার-ব্যবহার, রুচি-প্রকৃতি ইত্যাদি সবদিক দিয়ে তোমাদের সাথে আমাদের গভীর মিল। তাছাড়া ইসলাম ও কুফরীর সংঘর্ষে আমরা তোমাদের পক্ষই অবলম্বন করবো।
১৭২) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামানায়কোন ব্যক্তি নিয়মিত নামায না পড়ে মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারতো না। দুনিয়ার বিভিন্ন দল ও মজলিস যেমন তাদের বৈঠকগুলোতে কোন সদস্যের বিনা ওজরে অনুপস্থিত থাকাকে দলের প্রতি তার অনাগ্রহ মনে করে থাকে এবং পরপর কয়েকটি সভায় অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ বাতিল করে তাকে দল থেকে বের করে দেয়, ঠিক তেমনি ইসলামী জামায়াতের কোন সদস্যের জামায়াতের সাথে নামাযে গরহাযির থাকাকে সে জামানায় সে ব্যক্তির ইসলামের প্রতি অনাগ্রহের সুস্পষ্ট প্রমাণ মনে করা হতো। আর যদি সে অনবরত কয়েক বার জামায়াতে গরহাযির থাকতো তাহলে ধরে নেয়া হতো সে মুসলমান নয়। তাই বড় বড় কট্টর মুনাফিকদেরও সে যুগে পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদে হাযিরি দিতে হতো। কারণ এছাড়া তাদের মুসলমানদের দলের অন্তর্ভুক্ত থাকার আর দ্বিতীয় কোন পথ ছিল না। তবে যে জিনিসটা তাদের সাচ্চা ঈমানদার থেকে আলাদা করতো সেটি হচ্ছে এই যে, সাচ্চা মু’মিনরা বিপুল উৎসাহ আগ্রহ নিয়ে মসজিদে আসতো, জামায়াতের সময়ের পূর্বেই মসজিদে পৌঁছে যেতো এবং নামায শেষ হবার পরও মসজিদে বসে থাকতো। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে একথা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতো যে নামাযের প্রতি তাদের যথার্থই হৃদয়ের টান ও আগ্রহ রয়েছে। বিপরীত পক্ষে আযানের আওয়াজ কানে আসতেই মুনাফিকদের যেন জান বেরিয়ে যেতো। মন চাইতো না তবুও নেহাত দায়ে ঠেকে তারা উঠতো। তাদের মসজিদের দিকে আসার ধরনর দেখে পরিষ্কার বুঝা যেতো যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা আসছে না বরং অনিচ্ছায় নিজেদের টেনে টেনে আনছে। জামায়াত শেষ হবার পর এমনভাবে মসজিদ থেকে পালাতো যেন মনে হতো কয়েদীরা বন্দীশালা থেকে মুক্তি পেয়েছে। তাদের ওঠাবসা চলাফেরা তথা প্রতিটি পদক্ষেপ সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতো যে, আল্লাহর যিকিরের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্রও মানসিক টান ও আগ্রহ নেই।
১৭৩) অর্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহর কালাম ও রসূলের জীবন চরিত্র থেকে হিদায়াত লাভ করেনি, যাকে সত্য বিমুখ ও বাতিলের প্রতি গভীর অনুরাগী দেখে আল্লাহও তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন যেদিকে সে নিজে ফিরে যেতে চায় এবং তার গোমরাহীকে আঁকড়ে ধরার কারণে আল্লাহ তার জন্য হিদায়াতের দরজা বন্ধ করে কেবল মাত্র গোমরাহীর দরজা খুলে দিয়েছেন। এহেন ব্যক্তিকে সঠিক পথ দেখানো আসলে কোন মানুষের সাধ্যের অতীত। রিযিকের দৃষ্টান্ত থেকে এ বিষয়টি অনুধাবন করা যেতে পারে।

রিযিকের সমস্ত সম্পদ মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর ক্ষমতা ও কুদরতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন, এটা একটা জাজ্জ্বল্যমান সত্য। মানুষ যা কিছু পায়, যতটুকু পায় আল্লাহর কাছ থেকেই পায়। কিন্তু যে ব্যক্তি যে পথে রিযিক চায় আল্লাহ‌ তাকে সেই পথেই রিযিক দান করেন। যদি কোন ব্যক্তি হালাল পথে রিযিক চায় এবং সেজন্য প্রচেষ্টাও চালাতে থাকে তাহলে আল্লাহ‌ তার জন্য রিযিকের হালাল পথগুলো খুলে দেন। তার নিয়ত যে পরিমাণ সৎ ও নিষ্কলুষ হয় সেই পরিমাণ হারাম পথ তার জন্য বন্ধ করে দেন। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি হারাম খাবার জন্য উঠে পড়ে লাগে এবং এ জন্য চেষ্টা-চরিত্র করতে থাকে, আল্লাহর হুকুমে সে হারাম খাবারই পায়। এরপর তার ভাগ্যে হালাল রুজি লিখে দেবার ক্ষমতা আর কারো থাকে না। অনুরূপভাবে এটাও একটা জাজ্জ্বল্যমান সত্য যে, এই দুনিয়ায় চিন্তা ও কর্মের সমস্ত পথ আল্লাহ‌র ক্ষমতা ও ইখতিয়ারের অধীন। আল্লাহর হুকুম, অনুমতি ও তাওফীক তথা সুযোগ দান ছাড়া কোন একটি পথেও চলার ক্ষমতা মানুষের নেই। তবে কোন্ ‌ব্যক্তি কোন পথে চলার অনুমতি পায় এবং কোন্ পথে চলার উপকরণ তার জন্য সংগ্রহ করে দেয়া হয় এটা পুরোপুরি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিজের চাহিদা, প্রচেষ্টা ও সাধনার ওপর। যদি আল্লাহর সাথে তার মানসিক সংযোগ থাকে, সে সত্যানুসন্ধানী হয় এবং সাচ্চা নিয়তে আল্লাহর পথে চলার জন্য প্রচেষ্টা চালায় তাহলে আল্লাহ‌ তাকে তারই অনুমতি ও সুযোগ দান করেন। তখন এ পথে চলার যাবতীয় উপকরণ ও সরঞ্জাম তার আয়ত্তাধীন হয়ে যায়। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি গোমরাহী ও পথভ্রষ্টতা পছন্দ করে এবং ভুল পথে চলার জন্য চেষ্টা-সাধনা করে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য হিদায়াতের সমস্ত দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং সেই সমস্ত পথ তার জন্য খুলে দেয়া হয় যেগুলো সে নিজের জন্য বাছাই করে নিয়েছে। এহেন ব্যক্তিকে ভুল চিন্তা করার, ভুল কাজ করার ও ভুল পথে নিজের শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করা থেকে নিরস্ত রাখার ক্ষমতা কারো নেই। যে ব্যক্তি নিজেই তার ভাগ্যের সঠিক পথ হারিয়ে বসে এবং আল্লাহ‌ যাকে সঠিক পথ থেকে বঞ্চিত করেন, কেউ তাকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে এবং এই হারানো নেয়ামত খুঁজে দিতে পারে না।