আশ শূরা

সুরার ভূমিকা
দেখতে ক্লিক করুন

X close

নামকরণ

৩৮ আয়াতের وَاَمْرُهُمْ شُوْرَي بَيْنَهُمْ আয়াতাংশ থেকে এর নাম গৃহীত হয়েছে। এ নামের তাৎপর্য হলো, এটি সেই সূরা যার মধ্যে শূরা শব্দটি আছে।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল

নির্ভরযোগ্য কোন বর্ণনা থেকে এ সূরার নাযিল হওয়ার সময় কাল জানা যায়নি। তবে এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে চিন্তা করলে স্পষ্ট জানা যায়, সূরাটি حم السجدة সূরা নাযিল হওয়ার পরপরই নাযিল হয়েছে। কারণ, এ সূরাটিকে সূরা হা-মীম আস সাজদার এক রকম সম্পূরক বলে মনে হয়। যে ব্যক্তিই মনযোগ সহকারে প্রথমে সূরা হা-মীম আস সাজদা পড়বে এবং তারপর এ সূরা পাঠ করবে সে-ই এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে।

সে দেখবে এ সূরাটিতে কুরাইশ নেতাদের অন্ধ ও অযৌক্তিক বিরোধিতার ওপর বড় মোক্ষম আঘাত হানা হয়েছিল। এভাবে পবিত্র মক্কা ও তার আশেপাশের এলাকায় অবস্থানকারী যাদের মধ্যেই নৈতিকতা, শিষ্টাচার ও যুক্তিবাদিতার কোন অনুভূতি আছে তারা জানতে পারবে জাতির উচ্চস্তরের লোকেরা কেমন অন্যায়ভাবে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করছে আর তাদের মোকাবিলায় তাঁর কথা কত ভারসাম্যপূর্ণ, ভূমিকা কত যুক্তিসঙ্গত এবং আচার-আচরণ কত ভদ্র। ঐ সতর্কীকরণের পরপরই এ সূরা নাযিল করা হয়েছে। ফলে এটি যথাযথভাবে দিক নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেছে এবং একান্ত হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আন্দোলনের বাস্তবতা বুঝিয়ে দিয়েছে। কাজেই যার মধ্যেই সত্য প্রীতির কিছুমাত্র উপকরণ আছে এবং জাহেলিয়াতের গোমরাহীর প্রেমে যে ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যায়নি তার পক্ষে এর প্রভাবমুক্ত থাকা ছিল অসম্ভব ব্যাপার।

বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য

কথা শুরু করা হয়েছে এভাবেঃ তোমরা আমার নবীর পেশকৃত বক্তব্য শুনে এ কেমন আজেবাজে কথা বলে বেড়াচ্ছ ? কোন ব্যক্তির কাছে অহী আসা এবং তাকে মানবজাতির পথপ্রদর্শনের হিদায়াত বা পথনির্দেশনা দেয়া কোন নতুন বা অদ্ভূত কথা নয় কিংবা কোন অগ্রহণযোগ্য ঘটনাও নয় যে, ইতিহাসে এই বারই সর্বপ্রথম এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এর আগে আল্লাহ নবী-রসূলদের কাছে এ রকম দিক নির্দেশনা দিয়ে একের পর এক অনুরূপ অহী পাঠিয়েছেন। আসমান ও যমীনের অধিকর্তাকে উপাস্য ও শাসক মেনে নেয়া অদ্ভূত ও অভিনব কথা নয়। তাঁর বান্দা হয়ে, তাঁর খোদায়ীর অধীনে বাস করে অন্য কারো খোদায়ী মেনে নেয়াটাই বরং অদ্ভূত ও অভিনব ব্যাপার। তোমরা তাওহীদ পেশকারীর প্রতি ক্রোধান্বিত হচ্ছো। অথচ বিশ্ব-জাহানের মালিকের সাথে তোমরা যে শিরক করছো তো এমন মহা অপরাধ যে আকাশ যদি তাতে ভেঙ্গে পড়ে তাও অসম্ভব নয়। তোমাদের এই ধৃষ্টতা দেখে ফেরেশতারাও অবাক। তারা এই ভেবে সর্বক্ষণ ভীত সন্ত্রস্ত যে কি জানি কখন তোমাদের ওপর আল্লাহর গযব নেমে আসে।

এরপর মানুষকে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তিকে নবী হিসেবে নিয়োজিত করা এবং সেই ব্যক্তির নিজেকে নবী বলে পেশ করার অর্থ এ নয় যে, তাঁকে আল্লাহর সৃষ্টির ভাগ্য বিধাতা বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং সেই দাবি নিয়েই সে মাঠে নেমেছে। সবার ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ আল্লাহ নিজের হাতেই রেখেছেন। নবী এসেছেন শুধু গাফিলদের সাবধান এবং পথভ্রষ্টদের পথ দেখাতে। তাঁর কথা অমান্যকারীদের কাছে জবাবদিহি চাওয়া এবং তাদেরকে আযাব দেয়া বা না দেয়া আল্লাহর নিজের কাজ। নবীকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। তাই তোমাদের সমাজের তথাকথিত ধর্মীয় নেতা ও পীর ফকীররা যে ধরনের দাবী করে অর্থাৎ যে তাদের কথা মানবে না, কিংবা তাদের সাথে বে-আদবী করে তারা তাকে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, নবী এ ধরনের কোন দাবী নিয়ে এসেছেন বলে মনে করে থাকলে সে ভ্রান্ত ধারণা মন-মগজ থেকে ঝেড়ে ফেলো। এ প্রসঙ্গে মানুষকে একথাও বলা হয়েছে যে, নবী তোমাদের অমঙ্গল কামনার জন্য আসেননি। তিনি বরং তোমাদের কল্যাণকামী। তোমরা যে পথে চলছো সে পথে তোমাদের নিজেদের ধ্বংস রয়েছে, তিনি শুধু এ বিষয়ে তোমাদের সতর্ক করছেন।

অতপর আল্লাহ জন্মগতভাবে মানুষকে সুপথগামী করে কেন সৃষ্টি করেননি এবং মতানৈক্যের এই সুযোগ কেন রেখেছেন, যে কারণে মানুষ চিন্তা ও কর্মের যে কোন উল্টা বা সোজা পথে চলতে থাকে, এ বিষয়টির তাৎপর্য বুঝিয়েছেন। বলা হয়েছে, এ জিনিসের বদৌলতেই মানুষ যাতে আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করতে পারে সে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। ইখতিয়ারবিহীন অন্যান্য সৃষ্টিকূলের জন্য এ সুযোগ নেই। এ সুযোগ আছে শুধু স্বাধীন ইচ্ছা শক্তির অধিকারী সৃষ্টিকুলের জন্য যারা প্রকৃতিগতভাবে নয়, বরং জ্ঞানগতভাবে বুঝে শুনে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহকে নিজেদের অভিভাবক (PATRON, GUARDIAN) বানিয়েছে। যে মানুষ এই নীতি ও আচরণ গ্রহণ করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করার মাধ্যমে পথ প্রদর্শন করেন এবং সৎকাজের তাওফীক দান করে তাঁর বিশেষ রহমতের মধ্যে শামিল করে নেন। কিন্তু যে ব্যক্তি তার স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার ভুল পন্থায় ব্যবহার করে যারা প্রকৃত অভিভাবক নয় এবং হতেও পারে না তাদেরকে অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করে তারা এই রহমত হতে বঞ্চিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আরো বলা হয়েছে যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের ও গোটা সৃষ্টিকুলের অভিভাবক হচ্ছেন আল্লাহ। অন্যরা না প্রকৃত অভিভাবক, না আছে তাদের প্রকৃত অভিভাবকত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করার ক্ষমতা। মানুষ তার স্বাধীন ক্ষমতা ও ইখতিয়ার প্রয়োগ করে নিজের অভিভাবক নির্বাচনে ভুল করবে না এবং যে প্রকৃতই অভিভাবক তাকেই অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ করবে। এর ওপরই তার সফলতা নির্ভর করে।

তারপর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে দ্বীন পেশ করছেন তা প্রকৃতপক্ষে কি সে বিষয়ে বলা হয়েছেঃ

সেই দ্বীনের সর্বপ্রথম ভিত্তি হলো, আল্লাহ যেহেতু বিশ্ব-জাহান ও মানুষের স্রষ্টা, মালিক এবং প্রকৃত অভিভাবক তাই মানুষের শাসনকর্তাও তিনি। মানুষকে দ্বীন ও শরীয়ত (বিশ্বাস ও কর্মের আদর্শ) দান করা এবং মানুষের মধ্যকার মতানৈক্য ও মতদ্বৈততার ফায়সালা করে কোনটি হক এবং কোনটি না হক তা বলে আল্লাহর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। অন্য কোন সত্তার মানুষের জন্য আইনদাতা ও রচয়িতা (Law giver) হওয়ার আদৌ কোন অধিকার নেই। অন্য কথায় প্রাকৃতিক সার্বভৌমত্বের মত আইন প্রণয়নের সার্বভৌমত্বও আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। মানুষ বা আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্তা এই সার্বভৌমত্বের ধারক হতে পারে না। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর এই সার্বভৌমত্ব না মানে তাহলে তার আল্লাহর প্রাকৃতিক সার্বভৌমত্ব মানা অর্থহীন। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য প্রথম থেকেই একটি দ্বীন নির্ধারিত করেছেন।

সে দ্বীন ছিল একটিই। প্রত্যেক যুগে সমস্ত নবী-রসূলকে ঐ দ্বীনটিই দেয়া হতো। কোন নবীই স্বতন্ত্র কোন ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন না। আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য প্রথম দিন হতে ঐ দ্বীনটিই নির্ধারিত হয়ে এসেছে এবং সমস্ত নবী-রসূল ছিলেন সেই দ্বীনেরই অনুসারী ও আন্দোলনকারী।

শুধু মেনে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকার জন্য সে দ্বীন পাঠানো হয়নি। বরং পৃথিবীতে সেই দ্বীনই প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত থাকবে এবং যমীনে আল্লাহর দ্বীন ছাড়া অন্যদের রচিত দ্বীন যেন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সবসময় এ উদ্দেশ্যেই তা পাঠানো হয়েছে। শুধু এ দ্বীনের তাবলীগের জন্য নবী-রসূলগণ আদিষ্ট ছিলেন না, বরং কায়েম করার জন্য আদিষ্ট ছিলেন। এটিই ছিল মানবজাতির মূল দ্বীন। কিন্তু নবী-রসূলদের পরবর্তী যুগে স্বার্থান্বেষী মানুষেরা আত্মপ্রীতি, স্বেচ্ছাচার এবং আত্মম্ভরিতার কারণে স্বার্থের বশবর্তী হয়ে এ দ্বীনের মধ্যে বিভেদ ও বিরোধ সৃষ্টি করে নতুন নতুন ধর্ম সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে যত ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম দেখা যায় তার সবই ঐ একমাত্র দ্বীনকে বিকৃত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে।

এখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানোর উদ্দেশ্য হলো তিনি যেন বহুবিধ পথ, কৃত্রিম ধর্মসমূহ এবং মানুষের রচিত দ্বীনের পরিবর্তে সেই আসল দ্বীন মানুষের সামনে পেশ করেন এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা চালান। এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার পরিবর্তে তোমরা যদি আরো বিগড়ে যাও এবং সংঘাতের জন্য তৎপর হয়ে ওঠো তাহলে সেটা তোমাদের অজ্ঞতা। তোমাদের এই নির্বুদ্ধিতার কারণে নবী তাঁর কর্মতৎপরতা বন্ধ করে দেবেন না। তাঁকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আপনার ভূমিকায় অটল থাকেন এবং যে কাজের জন্য তিনি আদিষ্ট হয়েছেন তা সম্পাদন করেন। যেসব কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস এবং জাহেলী রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা ইতিপূর্বে আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করা হয়েছে তিনি তোমাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দ্বীনের মধ্যে তা অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করবেন তোমরা তাঁর কাছে এ প্রত্যাশা করো না।

আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করে অন্যদের রচিত দ্বীন ও আইন গ্রহণ করা আল্লাহর বিরুদ্ধে কত বড় ধৃষ্টতা সে অনুভূতি তোমাদের নেই। নিজেদের দৃষ্টিতে তোমরা একে দুনিয়ার সাধারণ ব্যাপার মনে করছো। তোমরা এতে কোন দোষ দেখতে পাও না। কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা জঘন্যতম শিরক এবং চরমতম অপরাধ। সেই সব লোককে এই শিরক ও অপরাধের কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে যারা আল্লাহর যমীনে নিজেদের দ্বীন চালু করেছে এবং তাদের দ্বীনের অনুসরণ ও আনুগত্য করেছে।

এভাবে দ্বীনের একটি পরিষ্কার ও সুস্পট ধারণা পেশ করার পর বলা হয়েছে, তোমাদেরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে সঠিক পথে নিয়ে আসার পথে নিয়ে আসার জন্য যেসব উত্তম পন্থা সম্ভব ছিল তা কাজে লাগানো হয়েছে। একদিকে আল্লাহ তাঁর কিতাব নাযিল করেছেন। সে কিতাব অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক পন্থায় তোমাদের নিজের ভাষায় তোমাদের কাছে প্রকৃত সত্য পেশ করছে। অপরদিকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সংগী-সাথীদের জীবন তোমাদের সামনে বর্তমান, যা দেখে তোমরা জানতে পার ‌এ কিতাবের দিক নির্দেশনায় কেমন মানুষ তৈরী হয়। এভাবেও যদি তোমরা হিদায়াত লাভ করতে না পার তাহলে দুনিয়ার আর কোন জিনিসই তোমাদেরকে সঠিক পথে আনতে সক্ষম নয়। কাজেই এখন এর ফলাফল যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, তোমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী যে গোমরাহীতে ডুবে আছো তার মধ্যেই ডুবে থাকো এবং এ রকম পথভ্রষ্টদের জন্য আল্লাহর কাছে যে পরিণতি নির্ধারিত আছে সেই পরিণতির মুখোমুখি হও।

এসব সত্য বর্ণনা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে সংক্ষেপে তাওহীদ ও আখেরাতের স্বপক্ষে যুক্তি-প্রমাণ পেশ হয়েছে, দুনিয়া পূজার পরিণাম সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে, আখেরাতের শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে এবং কাফেরদের সেই সব নৈতিক দুর্বলতার সমালোচনা করা হয়েছে যা তাদের আখেরাত থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মূল কারণ ছিল। তারপর বক্তব্যের সমাপ্তি পর্যায়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়েছেঃ

একঃ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের প্রথম চল্লিশ বছর কিতাব কি---এ ধারণার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলেন এবং ঈমান ও ঈমান সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে একেবারে অনবহিত ছিলেন। তারপর হঠাৎ এ দু’টি জিনিস নিয়ে তিনি মানুষের সামনে এলেন। এটা তাঁর নবী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

দুইঃ তাঁর পেশকৃত শিক্ষাকে আল্লাহর শিক্ষা বলে আখ্যায়িত করার অর্থ এ নয় যে, তিনি আল্লাহর সাথে সামনা-সামনি কথাবার্তা বলার দাবীদার। আল্লাহর এই শিক্ষা অন্য সব নবী-রসূলদের মত তাঁকেও তিনটি উপায়ে দেয়া হয়েছে। এক---অহী, দুই---পর্দার আড়াল থেকে আওয়াজ দেয়া এবং তিন---ফেরেশতার মাধ্যমে পয়গাম। এ বিষয়টি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যাতে বিরোধীরা এ অপবাদ আরোপ করতে না পারে যে, নবী (সা.) আল্লাহর সাথে সামনা-সামনি কথা বলার দাবি করছেন। সাথে সাথে ন্যায়বাদী মানুষেরা যেন জানতে পারে আল্লাহর পক্ষ থেকে যে মানুষটিকে নবুওয়াতের পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করা হয়েছে তাঁকে কোন্ কোন্‌ উপায় ও পন্থায় দিক নিদের্শনা দেয়া হয়।

مَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ ٱلْـَٔاخِرَةِ نَزِدْ لَهُۥ فِى حَرْثِهِۦ ۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ ٱلدُّنْيَا نُؤْتِهِۦ مِنْهَا وَمَا لَهُۥ فِى ٱلْـَٔاخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ﴿٢٠ أَمْ لَهُمْ شُرَكَـٰٓؤُا۟ شَرَعُوا۟ لَهُم مِّنَ ٱلدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَنۢ بِهِ ٱللَّهُ ۚ وَلَوْلَا كَلِمَةُ ٱلْفَصْلِ لَقُضِىَ بَيْنَهُمْ ۗ وَإِنَّ ٱلظَّـٰلِمِينَ لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌۭ﴿٢١ تَرَى ٱلظَّـٰلِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا كَسَبُوا۟ وَهُوَ وَاقِعٌۢ بِهِمْ ۗ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ فِى رَوْضَاتِ ٱلْجَنَّاتِ ۖ لَهُم مَّا يَشَآءُونَ عِندَ رَبِّهِمْ ۚ ذَٰلِكَ هُوَ ٱلْفَضْلُ ٱلْكَبِيرُ﴿٢٢ ذَٰلِكَ ٱلَّذِى يُبَشِّرُ ٱللَّهُ عِبَادَهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ وَعَمِلُوا۟ ٱلصَّـٰلِحَـٰتِ ۗ قُل لَّآ أَسْـَٔلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا ٱلْمَوَدَّةَ فِى ٱلْقُرْبَىٰ ۗ وَمَن يَقْتَرِفْ حَسَنَةًۭ نَّزِدْ لَهُۥ فِيهَا حُسْنًا ۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌۭ شَكُورٌ﴿٢٣ أَمْ يَقُولُونَ ٱفْتَرَىٰ عَلَى ٱللَّهِ كَذِبًۭا ۖ فَإِن يَشَإِ ٱللَّهُ يَخْتِمْ عَلَىٰ قَلْبِكَ ۗ وَيَمْحُ ٱللَّهُ ٱلْبَـٰطِلَ وَيُحِقُّ ٱلْحَقَّ بِكَلِمَـٰتِهِۦٓ ۚ إِنَّهُۥ عَلِيمٌۢ بِذَاتِ ٱلصُّدُورِ﴿٢٤
(২০) যে আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র চায় আমি তার কৃষিক্ষেত্র বাড়িয়ে দেই। আর যে দুনিয়ার কৃষিক্ষেত্র চায় তাকে দুনিয়ার অংশ থেকেই দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ নেই।৩৭ (২১) এসব লোক কি আল্লাহর এমন কোন শরীকে বিশ্বাস করে যে এদের জন্য দ্বীনের মত এমন একটি পদ্ধতি নির্ধারিত করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমোদন দেননি?৩৮ যদি ফায়সালার বিষয়টি পূর্বেই মীমাংসিত হয়ে না থাকতো তাহলে তাদের বিবাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়া হতো। ৩৯ এ জালেমদের জন্য নিশ্চিত কষ্টদায়ক শাস্তি রয়েছে। (২২) তোমরা দেখতে পাবে, সে সময় এসব জালেম তাদের কৃতকর্মের ভয়াবহ পরিণামের আশঙ্কা করতে থাকবে। আর সে পরিণাম তাদের জন্য আসবেই। পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তারা জান্নাতের বাগ-বাগিচার মধ্যে অবস্থান করবে। তারা যা-ই চাইবে তা-ই তাদের রবের কাছে পাবে। এটাই বড় মেহেরবানী। (২৩) এটাই সেই জিনিস যার সুসংবাদ আল্লাহ‌ তাঁর সেই সব বান্দাদের দেন যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে। হে নবী, এসব লোককে বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না।৪০ তবে আত্মীয়তার ভালবাসা অবশ্যই চাই।৪১ যে কল্যাণ উপার্জন করবে আমি তার জন্য তার সেই কল্যাণের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দেব। নিশ্চয়ই আল্লাহ‌ বড় ক্ষমাশীল ও নেক কাজের মর্যাদাদাতা।৪২ (২৪) এ লোকেরা কি বলে, এই ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে অপবাদ তৈরী করেছে?৪৩ আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমার দিলের ওপর মোহর মেরে দিতেন।৪৪ তিনি বাতিলকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং নিজের আদেশে সত্যকে সত্য প্রমাণ করে দেখান।৪৫ তিনি মনের গোপন বিষয়ও জানেন। ৪৬
৩৭) পূর্ববর্তী আয়াতে দু’টি সত্য তুলে ধরা হয়েছে, যা আমরা সবসময় সর্বত্র দেখতে পাই। একটি হচ্ছে আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানী তাঁর সব বান্দার জন্য সমান। অপরটি হচ্ছে, তাঁর দান ও রিযিক পৌঁছানোর বন্দোবস্ত সবার জন্য সমান নয়, বরং তার মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। সেখানে এ আয়াতে বলা হচ্ছে, তাঁর দয়া ও মেহেরবানী এবং রিযিক পৌঁছানোর ব্যবস্থায় ছোটখাট পার্থক্য অসংখ্য। কিন্তু একটি অনেক বড় মৌলিক পার্থক্যও আছে। সেটি হচ্ছে, আখেরাতের আকাংখী ব্যক্তির জন্য এক ধরনের রিযিক এবং দুনিয়ার আকাংখী ব্যক্তির জন্য অন্য ধরনের রিযিক।

এটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সত্য যা এই সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে বলা হয়েছে। এটিকে বিস্তারিতভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কারণ তা প্রত্যেক মানুষকে তার ভূমিকা নির্ধারণে সাহায্য করে। যারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ের জন্য চেষ্টা-সাধনা ও কাজ করে এ আয়াতে তাদেরকে এমন কৃষকের সাথে তুলনা করা হয়েছে যারা ভূমি প্রস্তুত করা থেকে ফসল প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত উপর্যুপরি ঘাম ঝরায় এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। সে মাঠে যে বীজ বপন করছে তার ফসল আহরণ করে যেন উপকৃত হতে পরে সেজন্য সে এত সব পরিশ্রম করে কিন্তু নিয়ত ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য এবং বেশীর ভাগই কর্মপদ্ধতির পার্থক্য ও আখেরাতের ফসল বপনকারী কৃষক এবং পার্থিব ফসল বপনকারী কৃষকের মধ্যে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করে তাই আল্লাহ‌ উভয় পরিশ্রমের ফলাফলও ভিন্ন রেখেছেন। অথচ এই পৃথিবীই উভয়ের কর্মক্ষেত্র।

আখেরাতের ফসল বপনকারী দুনিয়া লাভ করবে না আল্লাহ‌ তা বলেননি। কম বা বেশী যাই হোক না কেন দুনিয়া তো সে পাবেই। কারণ এখানে আল্লাহর মেহেরবানী সবার জন্য সমান এবং তার মধ্যে তারও অংশ আছে। তাই ভালমন্দ সবাই এখানে রিযিক পাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহ‌ তাকে দুনিয়া লাভের সুসংবাদ দান করেননি, বরং তাকে সুসংবাদ দিয়েছেন এই বলে যে তার আখেরাতের কৃষিক্ষেত্র বৃদ্ধি করা হবে। কেননা সে সেটিই চায় এবং সেখানকার পরিণামের চিন্তায় সে বিভোর। এই কৃষিক্ষেত্র বর্ধিত করার অনেকগুলো উপায় ও পন্থা হতে পারে। যেমনঃ সে যতটা সদুদ্দেশ্য নিয়ে আখেরাতের জন্য নেক আমল করতে থাকবে তাকে তত বেশী নেক আমল করার সুযোগ দেয়া হবে এবং তার হৃদয়-মন নেক কাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। যখন সে পবিত্র উদ্দেশ্যের জন্য পবিত্র উপায় অবলম্বন করার সংকল্প করবে তখন তার জন্য পবিত্র উপায়-উপকরণের মধ্যে বরকত দান করা হবে। তার জন্য কল্যাণের সব দরজা বন্ধ হয়ে কেবল অকল্যাণের দরজাসমূহই খোলা থাকবে, আল্লাহ‌ এ অবস্থা কখনো আসতে দেবেন না। তাছাড়া সব চেয়ে বড় কথা হলো তার এই পৃথিবীর সামান্য নেকীও আখেরাতে কমপক্ষে দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে। আর বেশীর তো কোন সীমাই থাকবে না। আল্লাহ‌ যার জন্য চাইবেন হাজার বা লক্ষগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন।

এখন থাকে দুনিয়ার কৃষি বপনকারীর কথা। অর্থাৎ যে আখেরাত চায় না এবং দুনিয়ার জন্যই সব কিছু করে। আল্লাহ‌ তাকে তার এই চেষ্টা-সাধনার দু’টি ফলের কথা সুস্পষ্টভাবে শুনিয়ে দিয়েছেন। এক, সে যত চেষ্টাই করুক না কেন দুনিয়া যতটা অর্জন করতে চায় তা সে পুরাপুরি পাবে না, বরং তার একটা অংশ মাত্র অর্থাৎ আল্লাহ‌ তার জন্য যতটা নির্দিষ্ট করে রেখেছেন ততটাই পাবে। দুই, সে যা কিছু পাবে এই দুনিয়াতেই পাবে। আখেরাতের কল্যাণে তার কোন অংশ থাকবে না।

৩৮) একথা সুস্পষ্ট যে এ আয়াতে شُرَكَاءُ অর্থে সেই সব শরীক বুঝানো হয়নি মানুষ যাদের কাছে প্রার্থনা করে বা যাদেরকে নযর-নিয়াজ দেয় কিংবা যাদের সামনে পূজা অর্চনার অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হয়। বরং নিশ্চিতভাবে সেই সব মানুষকে বুঝানো হয়েছে মানুষ যাদেরকে আদেশ দানের ক্ষেত্রে অংশীদার বানিয়ে নিয়েছে, যাদের শেখানো ধ্যান-ধারণা, আকীদা-বিশ্বাস, মতবাদ এবং দর্শনের প্রতি মানুষ বিশ্বাস পোষণ করে, যাদের দেয়া মূল্যবোধ মেনে চলে, যাদের পেশকৃত নৈতিক নীতিমালা এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির মানদণ্ডসমূহ গ্রহণ করে, যাদের রচিত আইন-কানুন, পন্থা ও বিধি-বিধানকে নিজেদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও ইবাদতসমূহে, ব্যক্তি জীবনে, সমাজে, সভ্যতায়, কায়কারবার ও লেনদেনে, বিচারালয়সমূহে এবং নিজেদের রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থায় এমনভাবে গ্রহণ করে যেন এটাই সেই শরীয়ত যার অনুসরণ তাদের করা উচিত। এটা যেন বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর রচিত আইনের পরিপন্থী একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এবং তাঁর অনুমোদন ছাড়াই উদ্ভাবকরা উদ্ভাবন করেছে এবং মান্যকারীরা মেনে নিয়েছে। আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কাউকে সিজদা করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা যেমন শিরক এটাও ঠিক তেমনি শিরক। (অধিক ব্যাখ্যার জন্য দেখুন তাফহীমুল কুরআন, সূরা বাকারা, আয়াত ১-৭২, টীকা ১৭০, আয়াত ২৫৬, টীকা ২৮৬; আল ইমরান আয়াত ৬৪ ও ৬৫, টীকা ৫৭ ও ৫৮, আয়াত ৭৫ থেকে ৭৭, টীকা ৬৪, ৬৫ ; আন নিসা, আয়াত ৬০, টীকা ৯০; আল মায়েদা, আয়াত ১ ও ২ টীকাসহ, আয়াত ৮৭ ও ৮৮ টীকাসহ; আন-আম, আয়াত ১১৯ থেকে ১২১, টীকাসহ, আয়াত ১৩৬, ১৩৭ টীকাসহ; আত তাওবা, আয়াত ৩১ টীকাসহ; ইউনুস আয়াত ৫৯, ৬০ টীকাসহ; ইবরাহীম, আয়াত ২২ টীকাসহ; মারয়াম, আয়াত ৪২ টীকাসহ; আল-কাসাস, আয়াত ৬২, ৬৩ টীকাসহ; সাবা আয়াত ৪১ টীকা ৬৩; ইয়সীন, আয়াত ৬০, টীকা ৫৩)।
৩৯) অর্থাৎ এটা আল্লাহর বিরুদ্ধে এমন এক ধৃষ্টতা যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ব্যাপারটি যদি কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য মুলতবী করা না হতো তাহলে আল্লাহর বান্দা হয়ে যারা আল্লাহর পৃথিবীতে নিজেদের রচিত ‘দ্বীন’ চালু করেছে তাদের প্রত্যেকের ওপর আযাব নাযিল করা হতো এবং তাদেরকেও ধ্বংস করে দেয়া হতো যারা আল্লাহর দ্বীন পরিত্যাগ করে অন্যদের রচিত দ্বীন গ্রহণ করেছে।
৪০) ‘এ কাজ’ অর্থ যে প্রচেষ্টার মাধ্যমে নবী ﷺ মানুষকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচানো এবং জান্নাতের সুসংবাদের উপযুক্ত বানানোর জন্য যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
৪১) মূল আয়াতের বাক্যাংশ হলো অর্থাৎ আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। তবে إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى র ভালবাসা অবশ্যই প্রত্যাশা করি। এই قُرْبَى শব্দটির ব্যাখ্যায় মুফসসিরদের মধ্যে বেশ মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে।

এক দল এ শব্দটিকে আত্মীয়তা (আত্মীয়তার বন্ধন) অর্থে গ্রহণ করেছেন এবং আয়াতের অর্থ বর্ণনা করেছেন এই যে, “আমি এ কাজের জন্য তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক বা বিনিময় চাই না। তবে তোমাদের ও আমাদের মাঝে আত্মীয়তার যে বন্ধন আছে তোমরা (কুরাইশরা) অন্তত সেদিকে লক্ষ্য রাখবে এতটুকু আমি অবশ্যই চাই। তোমাদের উচিত ছিল আমার কথা মেনে নেয়া। কিন্তু যদি তোমরা তা না মানো তাহলে গোটা আরবের মধ্যে সবার আগে তোমরাই আমার সাথে দুশমনী করতে বদ্ধপরিকর হবে তা অন্তত করো না।” এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যা। ইমাম আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর, তাবারানী, বায়হাকী, ইবনে সা’দ ও অন্যান্য পণ্ডিতগণ বহু সংখ্যক বর্ণনাকারীর মাধ্যমে এ ব্যাখ্যাটি উদ্ধৃত করেছেন এবং মুজাহিদ, ইকরিমা, কাতাদা, সুদ্দী, আবু মালেক, আবদুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম, দাহহাক, আতা ইবনে দীনার এবং আরো অনেক বড় বড় মুফাসসির এ ব্যাখ্যাটাই বর্ণনা করেছেন।

দ্বিতীয় দলটি قُرْبَى শব্দটিকে নৈকট্য বা নৈকট্য অর্জন অর্থে গ্রহণ করেন এবং আয়াতটির অর্থ করেছেন, তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নৈকট্যের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া ছাড়া আমি তোমাদের কাছে এ কাজের জন্য আর কোন বিনিময় চাই না। অর্থাৎ তোমরা সংশোধিত হয়ে যাও। শুধু এটাই আমার পুরস্কার। এ ব্যাখ্যা হাসান বাসারী থেকে উদ্ধৃত হয়েছে এবং কাতাদা থেকেও এর সমর্থনে একটি মত বর্ণিত হয়েছে। এমনকি তাবারানীর একটি বর্ণনায় ইবনে আব্বাসের সাথেও এ মতকে সম্পর্কিত করা হয়েছে। কুরআন মজীদেরও আরেক স্থানে বিষয়টি এ ভাষায় বলা হয়েছেঃ

قُلْ مَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ مِنْ أَجْرٍ إِلَّا مَنْ شَاءَ أَنْ يَتَّخِذَ إِلَى رَبِّهِ سَبِيلًا- الفرقان : 58

“এদের বলে দাও, এ কাজের জন্য আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না। যার ইচ্ছা সে তার রবের পথ অনুসরণ করুক, আমার পারিশ্রমিক শুধু এটাই।” তৃতীয় দলটি قُرْبَى শব্দটিকে নিকট আত্মীয় (আত্মীয় স্বজন) অর্থে গ্রহণ করেন। তারা আয়াতের অর্থ করেনঃ “তোমরা আমার আত্মীয় ও আপনজনদের ভালবাসবে এছাড়া আমার এ কাজের কোন পারিশ্রমিক আমি চাই না।” এই দলের কেউ আত্মীয়দের মধ্যে গোটা বনী আবদুল মুত্তালিবকে অন্তর্ভুক্ত করেন আবার কেউ কেউ একে শুধু হযরত আলী, ফাতেমা ও তাঁদের সন্তান-সন্ততি পর্যন্ত সীমিত রাখেন। এ ব্যাখ্যাটি সাঈদ ইবনে জুবায়ের এবং ‘আমর ইবনে শু’আইব থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। আবার কোন কোন বর্ণনাতে একে ইবনে আব্বাস ও হযরত আলী ইবনে হুসাইনের (যয়নুল আবেদীন) সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু কারণে এ ব্যাখ্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রথমত সন্তানের প্রশ্ন তো দূরের কথা মক্কায় যে সময় এ সূরা শূরা নাযিল হয় সে সময় হযরত আলী ও ফাতিমার বিয়ে পর্যন্ত হয়নি। বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীরও সবাই আবার নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সহযোগিতা করছিলো না। বরং তাদের কেউ কেউ তাঁর প্রকাশ্য দুশমনদের সহযোগী ছিল। এক্ষেত্রে আবু লাহাবের শত্রুতার বিষয় তো সর্বজনবিদিত। দ্বিতীয়ত, শুধু বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আত্মীয় ছিল না। নবীর ﷺ মহিয়ষী মা, তাঁর মহান বাপ এবং হযরত খাদীজার (রা.) মাধ্যমে কুরাইশদের সকল পরিবারের সাথেই তাঁর আত্মীয়তা ছিল। সেই সব পরিবারে নবীর ﷺ গুণী সাহাবা যেমন ছিলেন তেমনি ঘোরতর শত্রুও ছিল। তাই ঐ সব আত্মীয়দের মধ্য থেকে তিনি কেবল বনী আবদুল মুত্তালিব গোষ্ঠীকে নিজের ঘনিষ্ঠজন আখ্যায়িত করে এই ভালবাসার দাবীকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট রাখবেন তা নবীর ﷺ জন্য কি করে সম্ভব ছিল? তৃতীয়ত, যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, একজন নবী যে উচ্চাসনে দাঁড়িয়ে সুউচ্চ কন্ঠে আল্লাহর দিকে আহবান জানান সেই উচ্চাসন থেকে এ মহান কাজের জন্য তিনি এত নীচ পর্যায়ের পুরস্কার চাইবেন যে, তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনকে ভালবাসো, তা কোনত্রুমেই সম্ভব নয়। এটা এমনই নীচ পর্যায়ের ব্যাপার যে কোন সুস্থ-স্বাভাবিক রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি কল্পনাও করতে পারে না যে, আল্লাহ‌ তাঁর নবীকে একথা শিখিয়ে থাকবেন আর নবী কুরাইশদের মধ্যে দাঁড়িয়ে একথা বলে থাকবেন। কুরআন মজীদে নবী-রসূলদের যেসব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে তাতে আমরা দেখি একের পর এক নবী এসে তাঁদের কওমকে বলছেনঃ আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় প্রত্যাশা করি না। আমার পারিশ্রমিক বিশ্ব-জাহানের রব আল্লাহর কাছে প্রাপ্য (ইউনুস ৭২, হূদ ২৯ ও ৫১, আশ-শুআরা ১০৯, ১২৭, ১৪৫, ১৬৪ ও ১৮০ আয়াত)। সূরা ইয়াসীনে নবীর সত্যতা যাচাইয়ের মানদণ্ড বলা হয়েছে এই যে, তিনি দাওয়াতের ব্যাপারে নিস্বার্থ হন (আয়াত ২১)। কুরআন মজিদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখ দিয়ে বার বার একথা বলানো হয়েছে যে, আমি তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না (আল আনয়াম ৯০, ইউসুফ ১০৪, আল মু’মিনুন ৭২, আল ফুরকান ৫৭, সাবা ৪৭, সোয়াদ ৮৬, আত তুর ৪০, আল কলম ৪৬ আয়াত)। এরপরে একথা বলার কি কোন সুযোগ থাকে যে, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে আহবান জানানোর যে কাজ করছি তার বিনিময়ে তোমরা আত্মীয়-স্বজনকে ভালোবাসো। তাছাড়া যখন আমরা দেখি, এ ঈমানদারদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়নি বরং এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফেরদেরকে তখন তা আরো খাপছাড়া বলে মনে হয়। আগে থেকেই কাফেরদেরকে লক্ষ্য করেই গোটা বক্তব্য চলে আসছে এবং পরবর্তী বক্তব্যও তাদের লক্ষ্য করেই পেশ করা হয়েছে। বক্তব্যের এই ধারাবাহিকতার মধ্যে বিরোধীদের কাছে কোন রকম বিনিময় চাওয়ার প্রশ্ন কি করে আসতে পারে? বিনিময় চাওয়া যায় তাদের কাছে যাদের কাছে কোন ব্যক্তির তাদের জন্য সম্পাদিত কাজের কোন মূল্য থাকে। কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কাজের কি মূল্য দিচ্ছিলো যে, তিনি তাদের কাছে বলতেন, আমি তোমাদের জন্য যে কাজ করেছি তার বিনিময়ে তোমরা আমার আত্মীয়-স্বজনদের ভালবাসবে? তারা তো উল্টা সেটাকে অপরাধ মনে করছিলো এবং সেজন্য তাঁকে হত্যা করতে সংকল্পবদ্ধ ছিলো।

৪২) অর্থাৎ যারা জেনে বুঝে নাফরমানী করে সেই সব অপরাধীদের সাথে যে ধরনের আচরণ করা হয় নেক কাজে সচেষ্ট বান্দাদের সাথে আল্লাহর আচরণ তেমন নয়। তাদের সাথে আল্লাহর আচরণ হচ্ছে (১) তারা নিজের পক্ষ থেকে যতটা সৎকর্মশীল হওয়ার চেষ্টা করে আল্লাহ‌ তাদেরকে তার চেয়েও বেশী সৎকর্মশীল বানিয়ে দেন। (২) তাদের কাজকর্মে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায় অথবা সৎকর্মশীল হওয়ার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে গোনাহ সংঘটিত হয় আল্লাহ‌ তা উপেক্ষা করেন এবং (৩) যে সামান্য পরিমাণ নেক কাজের পুঁজি তারা নিয়ে আসে সেজন্য আল্লাহ‌ তাদেরকে মর্যাদা দেন এবং অধিক পুরস্কার দান করেন।
৪৩) এই প্রশ্নবোধক বাক্যাংশে তীব্র তিরস্কার প্রচ্ছন্ন আছে, যার সারকথা হলো, হে নবী, এসব লোক কি এতই দুঃসাহসী ও নির্ভিক যে তোমার বিরুদ্ধে আল্লাহ‌ সম্পর্কে মিথ্যা বলার মত ঘৃণিত অপবাদ আরোপ করতে আদৌ লজ্জা অনুভব করলো না? এরা তোমার বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে যে তুমি নিজেই এ কুরআন রচনা করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত করছো?
৪৪) অর্থাৎ এত বড় মিথ্যা কেবল তারাই বলে যাদের হৃদয়ে মোহর করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ‌ ইচ্ছা করলে তোমাকেও তাদের মধ্যে শামিল করে দেবেন। কিন্তু এটা তাঁর মেহেরবানী যে তিনি তোমাকে এই দল থেকে আলাদা করে রেখেছেন। এই জবাবের মাধ্যমে সেই সব লোকদের প্রতি তীব্র কটাক্ষ করা হয়েছে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এ অপবাদ আরোপ করছিলো। এর তাৎপর্য হচ্ছেঃ হে নবী, এরা তোমাকেও তাদের মত স্বভাবের মানুষ মনে করে নিয়েছে। এরা যেমন নিজ স্বার্থের জন্য বড় বড় মিথ্যা বলতে কুন্ঠিত হয় না। তেমনি মনে করে নিয়েছে তুমিও অনুরূপ আপন স্বার্থ হাসিলের জন্য একটি মিথ্যা সাজিয়ে এনেছো। কিন্তু এটা আল্লাহরই মেহেরবানী যে তিনি তাদের মত তোমার হৃদয়ে তো মোহর লাগাননি।
৪৫) অর্থাৎ এটা আল্লাহর নিয়ম যে তিনি বাতিলকে কখনো স্থায়িত্ব দান করেন না এবং পরিশেষে ন্যায় ও সত্যকে ন্যায় ও সত্য হিসেবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। অতএব, হে নবী (সা.), তুমি এসব মিথ্যা অপবাদের আদৌ পরোয়া করো না এবং নিজের কাজ করতে থাকো। এমন এক সময় আসবে যখন এসব মিথ্যা ধূলিকণার মত উড়ে যাবে। কিন্তু তুমি যা পেশ করছো তার ন্যায় ও সত্য হওয়া স্পষ্ট হয়ে যাবে।
৪৬) অর্থাৎ তিনি জানেন, তোমার বিরুদ্ধে এসব অপবাদ কেন আরোপ করা হচ্ছে এবং তোমাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য যে চেষ্টা-সাধনা করা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তার পেছনে কি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাজ করছে।